শনিবার, ৪ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

এই তীর-ধনুকে লক্ষ্যভেদ হবে না : সিপিডি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আয় ও ব্যয় কাঠামোর ভিতরে সমস্যা আছে, তাই ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে এই তীর-ধনুকে লক্ষ্যভেদ হবে না। তার দৃষ্টিতে আয় হচ্ছে ধনুক আর ব্যয় হচ্ছে তীর। বলেন, যদি একটা লক্ষ্য থাকে সে লক্ষ্য ভেদ করতে হলে তীর চালাতে হবে। আমরা (সিপিডি) ধনুক ও তীরে, সেই টান এবং শক্তি দেখতে পাচ্ছি না। তাই এই তীর-ধনুকে লক্ষ্যভেদ হবে বলে তার এখনো মনে হচ্ছে না। ফলত বাজেট পেয়ে প্রাজ্ঞ এই অর্থনীতিবিদ ‘অস্বস্তিমূলক স্বস্তির মধ্যে’ আছেন।

গতকাল রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে সিপিডি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ‘জাতীয় বাজেট— ২০১৬-১৭ : সিপিডি পর্যালোচনা’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন শেষে তিনি বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান। পাশে ছিলেন সংস্থাটির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ গবেষণা সহযোগীরা। সংবাদ সম্মেলনে বাজেট পর্যালোচনার মূল বক্তব্য তুলে ধরতে গিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে ১১১টি স্লাইড উপস্থাপন করেন। তিনি প্রস্তাবিত বাজেটের অধিকাংশের সঙ্গে একমত এবং কিছু অংশের সঙ্গে দ্বিমতও পোষণ করেন। মূল বক্তব্যের শুরুতে তিনি টাকার বিনিময় হারে অতিমূল্যায়ন হওয়া নিয়ে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ ও দেশে চালের উত্পাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রতি বছর বাজেটে ‘বাড়তি’ প্রাক্কলন এবং অর্থবছর শেষে তা অর্জন করতে না পারার মধ্য দিয়ে ‘আস্থার সংকট’ তৈরি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে তেলের দরপতন হওয়ার পর বাংলাদেশে ‘দাম সমন্বয়ে’ গরিবের উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না। বাজেটে আর্থিক সক্ষমতার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি—এডিপি দুর্বলভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতেও দুর্বলতা আছে। প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে একমত হলেও আয় এবং ব্যয়ের কাঠামো ও ঘাটতি অর্থায়নের পরিকল্পনায় ‘দুর্বলতা’ দেখছেন তিনি। তবে প্রস্তাবিত বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেট জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, তা বলার দুঃসাহস আমার নেই। ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অসম্ভব হওয়াটা কিছু নয়। এটা অর্জনের পূর্বশর্ত আমাদের আছে কিনা, সেটা বড় বিষয়। পুঁজিবাজার ও ব্যাংক নাজুক অবস্থায় আছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এখনো কার্যকর হচ্ছে না। তার মতে, শ্রমবাজারে পরিবর্তন হচ্ছে। মজুরি শ্রমিক বাড়ছে। কিন্তু করপোরেট খাতে বড় বা মধ্যসারিতে চাকরি হচ্ছে না। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের অভাবে শিল্প খাতে বিগত দুই বছরে বিনিয়োগ কমে গেছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব—পিপিপিতে বড় আশঙ্কা হচ্ছে, উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া। আর্থিক খাতে সংস্কার পদক্ষেপ যথেষ্ট দেখছি না। অথচ যারা করের আওতায় আছেন, তাদের ওপরই করচাপ বাড়ল। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্য অর্জনে বাড়তি আরও ৮০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ লাগবে। সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির অনুঘটক হতে হবে কৃষি ও শিল্প খাতে। ওই সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মোট ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটকে কেউ কেউ ‘বড় বাজেট’ বা ‘ঐতিহাসিক বাজেট’ বললেও তার সঙ্গে ‘একমত নন’ জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে তার মূল বক্তব্যে আরও বলেন, বাজেট বড় হয়নি। প্রতি বছর বাজেটে টাকার অঙ্ক বাড়লেও মোট অর্থনীতির শতকরা হারের হিসাবে সেই ১৪ দশমিক ৩ শতাংশেই স্থবির হয়ে ‘আটকে’ আছে, আর বাড়ছে না। আপনারা শোনেন যে, লাখ লাখ কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে, বড় বাজেট হচ্ছে। বাজেট তো বড় হবে, অর্থনীতি বড় হলে বাজেট বড় হবে। কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা এবং ব্যয়ের পরিমাণও বড় হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের অর্থনীতি যেভাবে বাড়ছে, সে অনুপাতে বাজেটে আয়-ব্যয়ের খাতগুলো বাড়ছে কিনা— সে বিষয়ে মনোযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। তিনি বলেন, জিডিপির অংশ হিসেবে এ বাজেট বড়ও না, বিরাট কিছুও না। অর্থনীতিবিদ টাকার অঙ্কে প্রচলিত টাকা দেখেন না, তিনি প্রকৃত মূল্য বিবেচনা করেন। আজকের এক টাকা যে কালকে আধা টাকা হয়ে যায়, সেই কথাটা আমাদের বুঝতে হবে।

বাজেটে শিক্ষা, প্রযুক্তি, জনসেবা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, মেগা প্রকল্পে অর্থায়ন, কর ও শুল্ক কাঠামোয় স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টাকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি। তবে বিদেশি সাহায্য ব্যবহার, এডিপি বাস্তবায়ন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর আহরণের কৌশল নিয়ে বাজেটে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি জানিয়ে অতি প্রাক্কলনের প্রবণতার সমালোচনা করেন সিপিডির এই কর্তা।

তিনি বলেন, কোনো নীতি ঘোষণার পর তাতে আস্থা পেতে হলে, ওই নীতিকে আরও ‘নির্দিষ্ট’ ও ‘শক্তিশালী’ হতে হয়। যদি প্রক্ষেপণে বিশ্বাস না থাকে, প্রক্ষেপণের সেই অর্থে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেলে নীতির দক্ষতা নষ্ট হয়ে যায় এবং তখন কেউই তা গুরুত্বসহকরে গ্রহণ করে না। তিনি প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, সেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রায় ৮০.৫ শতাংশ অর্জিত হলেও বাংলাদেশে হয় ৭৩ শতাংশ। ভারত যেখানে কর আদায়ে লক্ষ্যের ৯৩ শতাংশ পূরণ করতে পারে, সেখানে বাংলাদেশে হয় ৮০ শতাংশের নিচে। প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারত ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করে, আর বাংলাদেশ করে ৮১.৫ শতাংশ।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেটে বড় ধরনের কর প্রাক্কলন (২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা) করে রাজস্ব বাড়ানোর কথা থাকলেও তা আদায়ে বা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে কী কৌশল নেওয়া হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট রূপরেখা দেখছেন না। বড় ধরনের করের প্রাক্কলন করে বড় ধরনের বিনিয়োগে অর্থায়নের চেষ্টা রয়েছে। ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। এজন্য বলা হচ্ছে, মোট বিনিয়োগ ৩১ শতাংশ হবে। এর আগে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কম ছিল, এবার ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোটাই আবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে। একই কথা তিনি বলেছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি—এডিপি বাস্তবায়ন নিয়েও। এডিপি ‘দুর্বলভাবে’ বাস্তবায়ন হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দেশে আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব খুবই প্রকটভাবে এসেছে ব্যাংকিং খাতের ভিতরে। এ বাজেটের ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে অর্থায়নের বিষয়টিকে ‘অন্যতম দুর্বলতা’ হিসেবে চিহ্নিত করে দেবপ্রিয় বলেন, ওই ঘাটতির ৪০ শতাংশ বিদেশি অর্থায়নে মেটানোর কথা বলা হলেও সেজন্য বড় কোনো উদ্যোগের কথা বাজেট কাঠামোয় নেই। ঘাটতি মেটাতে দেশীয় উৎস থেকে ৬১ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা ধার করার যে পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে, তাতে ব্যয় আরও বাড়বে। প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন ব্যয়ের চেয়ে অনুন্নয়ন ব্যয় বেশি ধরার তীব্র সমালোচনা করে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় বলেন, উন্নয়ন খাতেই বরাদ্দ বেশি দিতে হবে। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাস্তবায়ন থেকে সরকারের পিছিয়ে যাওয়ার পর আগামী বছরও যাতে একই পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর