রবিবার, ৫ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

পাঁচ চ্যালেঞ্জে বাজেট

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

পাঁচ চ্যালেঞ্জে বাজেট

প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নে বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এমন নয় যে এ চ্যালেঞ্জগুলো হঠাৎ সৃষ্টি হয়েছে। আগেও ছিল। বরং মধ্যম আয়ের স্বপ্ন পূরণে সরকারের যে জাতীয় কৌশল রয়েছে, সেই কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব প্রাক্কলন করতে অর্থমন্ত্রী বাধ্য হয়েছেন, সেটিই ওই চ্যালেঞ্জগুলোকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। প্রশ্ন হলো, সেই চ্যালেঞ্জগুলো কী, যা মোকাবিলা করতে হবে অর্থমন্ত্রীকে? এগুলো হচ্ছে— ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো, বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়িয়ে উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো শেষ করা এবং সরকারি বিনিয়োগের গুণগত মান নিশ্চিত করা, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় বাড়ানো, শ্রম ও মূলধনের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করা।

আশার কথা হচ্ছে, এই চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী নিজেও অবহিত। প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে সরকারের ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি’ শিরোনামে যে পৃথক পুস্তিকা দেওয়া হয়েছে, তার পঞ্চম পৃষ্ঠায় এই চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখ রয়েছে। আর এগুলো মোকাবিলায় সেখানে কিছু কৌশলও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৪ শতাংশের বেশি আসে ব্যক্তি খাত থেকে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতির নানা সাফল্যের মাঝেও বেসরকারি বিনিয়োগে কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি। তাই এ পরিস্থিতির উন্নয়নে বিনিয়োগবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও অন্যান্য সেবা সহজলভ্য করা এবং আর্থিক খাতের সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ উদ্বুদ্ধকরণের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।’

এই পাঁচ চ্যালেঞ্জ যদি মোকাবিলা না করা যায়, কী হতে পারে? ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ না বাড়াতে পারলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে না। প্রস্তাবিত বাজেটে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, এই পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অতিরিক্ত ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যবসায়ীদের আস্থা, সহায়ক কর-কাঠামো এবং অবকাঠামো সুবিধা। এর মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে বলে মনে করছে সরকার। বাজেট ঘোষণায় সেটি বলাও হয়েছে। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিয়ে যে বিনিয়োগ টানা সম্ভব নয় সেটি চলতি বছরই প্রমাণ হয়েছে। সরকার অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যুেকন্দ্র ও এলএনজি গ্যাস টার্মিনাল স্থাপনে একাধিক অগ্রাধিকার প্রকল্পও রয়েছে। তবে এগুলোর সুফল মিলতে সময় লাগবে। এর পরের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়িয়ে উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো শেষ করা এবং সরকারি বিনিয়োগের গুণগত মান নিশ্চিত করা। এ বিষয়টি নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে, তবে সুফল মিলছে না খুব একটা। বিশেষত বিদেশি অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোর ঢিলেমি রয়েছে। এমন অনেক প্রকল্প রয়েছে, যা বছরের পর বছর ধরে তালিকায় থাকছে কোনো ধরনের বরাদ্দ ছাড়া বা নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে। বাজেট প্রতিক্রিয়ায় সিপিডি বলেছে, ১ হাজার ১৭২টি অননুমোদিত প্রকল্প কোনো ধরনের বরাদ্দ ছাড়াই বছর বছর টেনে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। বড় বড় অনেক প্রকল্প সময়মতো শেষ করতে না পারায় ব্যয় বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন হাইওয়ের কাজ আরও তিন বছর আগে শেষ করার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। এ প্রকল্পেও ব্যয় বেড়েছে একাধিকবার। দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পটি ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রায় ১৮ হাজার কোটি ব্যয় ধরে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে এপ্রিলে একনেকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আরেক অগ্রাধিকার প্রকল্প পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেললাইন নির্মাণব্যয় প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে অনুমোদিত ছোট ছোট প্রকল্পের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় বলে এগুলো খুবই নিচু মানের হয়। রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের বিষয়টি সম্প্রতি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। চ্যালেঞ্জ রয়েছে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব অর্জনেও। অর্থমন্ত্রী নিজেই বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করেছেন প্রাক্কলিত রাজস্ব উচ্চাভিলাষী। লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজস্ব আয়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। চলতি অর্থবছর এ খাতে প্রবৃদ্ধি মেরে-কেটে ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করছে খোদ এনবিআর। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে সামগ্রিক বাজেট কাঠামো হুমকিতে পড়বে। লক্ষ্যমাত্রা কমাতে হবে ফলে ঘাটতি বেড়ে যাবে। দেখা যাবে সংশোধিত বাজেটের আকারও প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে বরাবরের মতোই কমে যাচ্ছে। এরপর রয়েছে শ্রম ও মূলধনের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত করা। এই চ্যালেঞ্জগুলো টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং পুরো বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গেই জড়িত। আর্থিক খাতের সংস্কার না করতে পারলে রিজার্ভ চুরি আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে হলমার্ক-বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট চলতেই থাকবে। আর বছর বছর জনগণের করের টাকায় মূলধন ঘাটতি মেটাতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের। ফলে মধ্যম আয়ের স্বপ্ন পূরণে যে দীর্ঘ পথ পারি দেওয়ার চেষ্টা করছেন অর্থমন্ত্রী, বছর শেষে দেখা যাবে ঘুরেফিরে ঠিক সেখানেই রয়ে গেছেন। বাংলাদেশের আলোচিত একটি চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’, যাতে অভিনয় করেছেন কিংবদন্তি অভিনেতা খান আতাউর রহমান। সেখানে তিনি একটি গান গেয়েছেন। গানটি হচ্ছে, ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে...’। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সমন্বয় করতে হলে আওয়ামী লীগ সরকারের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে এখন সেই খাঁচাটি ভাঙতে হবে। দৃঢ়তার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে।

সর্বশেষ খবর