সোমবার, ৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

এবার এসপির স্ত্রী খুন

প্রকাশ্যে মোটরসাইকেলে এসে কুপিয়ে ও গুলি করে পালায় খুনিরা, সন্দেহে জঙ্গি

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

এবার এসপির স্ত্রী খুন

নিহত মিতু, স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আকতারের সঙ্গে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে লাশ নেওয়ার প্রস্তুতি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল সকাল পৌনে ৭টায় প্রকাশ্য দিবালোকে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ধারণা, জঙ্গি দমনে বাবুল আক্তারের বিশেষ ভূমিকার কারণে প্রতিশোধ হিসেবেই তার স্ত্রীকে খুন করেছে জঙ্গিরা। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কিলিংয়ের সময় মিতুর সঙ্গে তার ছেলে আক্তার মাহমুদ মাহি থাকলেও সৌভাগ্যবশত ছোট্ট ছেলেটি দৌড়ে পালিয়ে রক্ষা পায়। অন্যদিকে, ইতিমধ্যে হত্যাকাণ্ডের    সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারে র‌্যাব-পুলিশ অভিযান শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। হত্যাকাণ্ডের সময় বাবুল আক্তার ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। সম্প্রতি পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত হয়েছিলেন বাবুল। স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েই হেলিকপ্টারযোগে চট্টগ্রামে পৌঁছান তিনি। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তারের বাসা পরিদর্শনকালে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে এসব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, ‘পুলিশের মনোবল ভেঙে দিতেই জঙ্গিরা এ হামলা চালিয়েছে। পুলিশের কাউকে হত্যা করলেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানে পুলিশের মনোবল ভেঙে যাবে এ ধারণা থেকে এ হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পুলিশের তো মনোবল ভ?াঙবে না। এরই মধ্যে এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান শুরু করা হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘জঙ্গি দমনে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের পরিবারের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে সরকার।’ প্রায় একই কথা বলেছেন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান। তিনি বলেন, এ ঘটনাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বাবুল আক্তারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন এমন অফিসারদের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা বিশেষ পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সকাল তখন পৌনে ৭টা। ছেলে আক্তার মাহমুদ মাহিকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিতে চট্টগ্রাম নগরীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা জিইসির মোড়ে যান বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। মোড় সংলগ্ন ‘ওয়েল ফুড’ নামের মিষ্টির দোকানের বিপরীত দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় একটি মোটরসাইকেল এসে মাহিকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। মাহি চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে প্রথম শ্রেণির ছাত্র। ছেলেকে তোলার চেষ্টা করছিলেন মা মিতু। এ সময় মোটরসাইকেলে থাকা এক যুবক মিতুর শরীরে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে মোটরসাইকেল আরোহী আরেক যুবক মিতুর কপাল বরাবর গুলি করে। মুহৃর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মিতু। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায় ঘাতক দল। র‌্যাব-৭ অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতার করতে র‌্যাব ও অন্য সংস্থাগুলো যৌথভাবে কাজ করছে।’ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোক্তার আহমেদ বলেন, ‘বাবুল আক্তার জঙ্গি দমনে অনেক কাজ করেছেন। তাই জঙ্গিরাই পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি।’ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বাবুল আক্তারের ছেলে আক্তার মাহমুদ মাহি কাঁদতে কাঁদতে বলে, তিনজন লোক মোটরসাইকেলে করে এসে মাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। পরে মায়ের পেটে তারা চাকু দিয়ে আঘাত করে। এরপর মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়।’ ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী নিরিবিলি হোটেলের কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাসা থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে আসার পথে হঠাৎ নজরে পড়ে হোটেলের নিচে অচেনা এক যুবক মোবাইল ফোনে কথা বলছে। জিন্স পরা ওই যুবক কিছুক্ষণ পর রাস্তা পার হলো। এরপর একটি মোটরসাইকেল ছেলের হাত ধরে হাঁটতে থাকা নারীকে ধাক্কা দেয়। তখন ওই মোটরসাইকেলে দুই যুবক ছিল। তারা নেমেই নারীকে মারধর ও ছুরিকাঘাত শুরু করলে ছোট্ট শিশুটি দৌড়ে পালিয়ে যায়। একপর্যায়ে ওই নারী উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে গুলির শব্দ শুনতে পাই। অতঃপর তিনজন মোটরসাইকেলে উঠে পড়লেও ২-৩ মিনিট মোটরসাইকেলটি স্টার্ট হয়নি। তারপর স্টার্ট নিল। গোলপাহাড়ের দিকে পালিয়ে গেল তিনজন। পরে জানতে পারি হামলায় নিহত ওই নারী এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী।’ জিইসি মোড়ের ইকুইটি সেন্ট্রিয়াম ভবনের নিরাপত্তা কর্মী আবদুল সাত্তার বলেন, ‘মাহিকে (বাবুল আক্তারের ছেলে) কাঁদতে দেখে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? এ সময় মাহি জানায়, তিনজন ব্যক্তি তার মাকে মেরে ফেলেছে। তখন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলাম তার নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। পরে মাহিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সবাইকে খবর দিই। বাসা থেকে একটা চাদর এনে ভাবীর শরীর ঢেকে দিই।’ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চট্টগ্রাম ইউনিটের পরিদর্শক মিমশ্রী বড়ুয়া জানান, সুরতহাল প্রতিবেদনে মিতুর শরীরে আটটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার মধ্যে বুকে দুটি, পিঠে দুটি, বাঁ হাতে দুটি এবং কনুইতে দুটি ছুরিকাঘাত করা হয়। বুকের ছুরিকাঘাতে আধা ইঞ্চির মতো গভীর ক্ষত হয়েছে। কপালে গুলিটি দেড় ইঞ্চির মতো গভীরে ঢুকে।

সিসি টিভির ফুটেজে মিতু হত্যাকাণ্ড : সকাল তখন পৌনে ৭টা। স্পট চট্টগ্রাম নগরীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা জিইসির মোড় সংলগ্ন ‘ওয়েল ফুড’ নামক মিষ্টির দোকান। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া আক্তার মাহমুদ মাহিকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাচ্ছিলেন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু। হঠাৎ মোটরসাইকেলে করে এসে দুই যুবক তাকে ধাক্কা দেয়। তিনি মাটিতে পড়ে গেলে এক যুবক প্রথমে তাকে ছুরিকাঘাত করে। পরে আরেক যুবক তাকে গুলি করে। মাত্র ৪০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের মধ্যে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় স্পটে থাকা আরেক যুবকসহ মোট তিনজন। দেশের আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে হত্যার দৃশ্য ধরা পড়ে ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজে। ফুটেজ পাওয়ার পর এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান শুরু করেছে পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা।

প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত : মাহমুদা খানম মিতুর প্রথম জানাজা রবিবার বিকালে নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহারসহ বিপুলসংখ্যক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন থানার ওসিরা অংশ নেন।

আইজিপির শোক : এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানমের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক। তিনি মরহুমার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।

রামপুরায় বাবার বাসায় মিতুর মরদেহ : পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খাতুন মিতুর (৩২) মরদেহ রাজধানীর রামপুরায় তার বাবার বাসায় আনা হয়েছে। গতকাল রাত পৌনে ১০টার দিকে খিলগাঁও মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ার ২২০/এ নম্বর বাড়িতে অ্যাম্বুলেন্সে করে তার মরদেহ আনা হয়। বাংলানিউজ

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) খিলগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার নূর আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চট্টগ্রাম নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে মিতুর মরদেহ ঢাকায় আনা হয়।

খুনের ঘটনায় মামলা, আটক হয়নি কেউ : মিতুর খুনের ঘটনায় রাতে হত্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। গতকাল রাত সোয়া ১১টার দিকে নগরীর পাঁচলাইশ থানার এসআই ত্রিরতন অজ্ঞাতনামা ৪-৫ জনকে আসামি করে ওই হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (পাঁচলাইশ অঞ্চল) আসিফ মাহমুদ মামলা হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন।

সর্বশেষ খবর