বুধবার, ৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

শ্রম দরজা খুলে গেল সৌদি আরবে

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

পরিবর্তিত কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে খুলে যাচ্ছে সৌদি আরবের শ্রমবাজারের দরজা। দীর্ঘ নয় বছর বন্ধ থাকার পর প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে দেখা দিয়েছে নতুন আশা। সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ জনশক্তি নেওয়ার কথা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছে। দক্ষ জনশক্তির বিষয়ে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছে বিশেষ আগ্রহ। কিন্তু সুযোগ পাবেন বড়সংখ্যক অদক্ষ শ্রমিকও। আগামি দু-তিন মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে একটি কাঠামো তৈরি করা হবে বলে জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। ঢাকা ও রিয়াদের সূত্রগুলো জানায়, সৌদি বাদশাহ সালমানের আমন্ত্রণে সফরে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে মূল এজেন্ডাগুলোর মধ্যে ছিল বিনিয়োগ ও শ্রমবাজার। সৌদি সামরিক জোটে অংশগ্রহণসংক্রান্ত বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছে সহযোগিতার চিত্র। এখন শ্রমবাজার, বিনিয়োগসহ দ্বিপক্ষীয় সব ইস্যুতেই ইতিবাচক আগ্রহ সৌদি সরকারের; যার প্রতিফলন পাওয়া গেছে বাদশাহ সালমানের সঙ্গে বৈঠকে। এরই ধারাবাহিকতায় সৌদি শ্রমমন্ত্রী মোফারেজ আল-হকুবানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে পাঁচ লাখ শ্রমিক নেওয়ার আগ্রহ সরাসরি উপস্থাপন করেন। সূত্রমতে, বৈঠকে বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রশংসা করে সৌদি শ্রমমন্ত্রী বলেছেন, ৪২ হাজার নারীসহ যে ১২ লাখের বেশি বাংলাদেশি সৌদি আরবে কাজ করছেন, তাদের প্রায় সবার কাজই প্রশংসার যোগ্য। নিয়োগকর্তাদের কাছে তাদের বেশ সুনামও আছে। সৌদি মন্ত্রী বৈঠকে বলেছেন, ‘এবার সাধারণ শ্রমিক ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও শিক্ষক নেওয়ার টার্গেট রাখা হয়েছে।’ এ সময় সৌদি মন্ত্রী অদক্ষ শ্রমিক ও গৃহকর্মী নিয়োগে খরচ বেশি হওয়ার বিষয় তুললে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক নিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি সৌদি শ্রমমন্ত্রীকে ঢাকায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে সুনির্দিষ্ট কাঠামো গঠনের কথা বলার পাশাপাশি সৌদি আরবে মধ্যস্বত্বভোগীদের স্থান না দেওয়ার আহ্বান জানান। এ সময় সৌদি মন্ত্রী একে গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন। নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও অগ্রাধিকারে রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘আমরা বিদেশে কাজ করতে আসা নারীদের বর্তমানে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। শিগগির একে দীর্ঘমেয়াদি করা হবে।’ জানা যায়, সংখ্যার হিসাবে সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। কিন্তু ২০০৮ সালে হঠাৎ ভিসা চালু করেই ভিসা বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব। এর আগে ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬৩ জন বাংলাদেশি গিয়েছেন সৌদি আরবে। শেষের দিকে প্রতি বছর দেড় থেকে দুই লাখ কর্মী গেছেন দেশটিতে। কিন্তু অব্যাহত অপপ্রচার ও কিছু বাংলাদেশির অপরাধপ্রবণতার কারণে বন্ধ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেয় রিয়াদ। ফলে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি অর্ধেকে নেমে আসে। একই সময়ে সৌদি সরকার বাংলাদেশি কর্মীদের ইকামা (কাজের অনুমতিপত্র) বদলেরও সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সৌদি আরব সফরে গিয়ে বাদশাহকে আবার কর্মী নেওয়ার, ইকামা ও পেশা পরিবর্তন এবং সাধারণ ক্ষমার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানান। তখন আশ্বাস দিলেও তাত্ক্ষণিক সাড়া পাওয়া যায়নি সৌদি সরকারের। ফলে অব্যাহতভাবে কূটনৈতিক তত্পরতা চালাতে থাকে সরকার। পদক্ষেপ নেওয়া হয় সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনতে। এরই মধ্যে ২০১২ সালের মার্চে ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খালাফ আল আলী খুন হন। নিহত খালাফের পরিবারসহ সৌদি সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখা হয় কূটনৈতিক পর্যায়ে, সেই সঙ্গে ঢাকায় দ্রুত চলতে থাকে বিচারিক কার্যক্রম। দুই আসামির ফাঁসির রায় হলে আশ্বস্ত হয় পরিবার ও সৌদি সরকার। এর মধ্যেই শ্রমবাজার চালু করতে নিবিড় চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন সাবেক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনও। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি পাঁচবার সৌদি আরব সফর করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বার বার বৈঠক করেন। লাগাতার এ চেষ্টার ফলে ২০১৩ সালের মার্চের শেষে ঢাকা সফরে আসে সৌদি স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল। পরে সৌদি সরকার ২০১৩ সালের ১০ মে থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে বসবাসরত অবৈধ বাংলাদেশিদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। একই সঙ্গে ইকামা ও পেশা পরিবর্তনেরও সুযোগ দেয়। ৭ লাখ ৯৯ হাজার ১৮৬ জন বাংলাদেশি সাধারণ ক্ষমার এ সুবিধা পান। কিন্তু বন্ধ থাকে নতুন নিয়োগ। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এসে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার ওপর জারি থাকা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব সৌদি মন্ত্রিসভায় পাস হয়। একই মাসের শেষ নাগাদ সৌদি রয়েল কোর্ট তা অনুমোদন দেয়। এরপর নিয়োগসংক্রান্ত প্রক্রিয়া দেখতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবার সফর করে সৌদি প্রতিনিধি দল। তখন চুক্তি হয় শুধু নারী শ্রমিক নেওয়ার। কথা ছিল প্রতি মাসে ১০ হাজার নারী শ্রমিক যাবেন সৌদি আরবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও হয়নি। খরচ বেশির কথা বলে নিয়োগকর্তারা অনাগ্রহ দেখান। আবার সৌদি আরবে কর্মরত নারীদের ওপর অকথ্য নির্যাতনের অভিযোগও আসতে থাকে। ফলে সেই একই বন্ধ দশায় থেকে যায় সৌদি আরবের শ্রমবাজার। এবার নতুন কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে দেখা দিয়েছে নতুন সম্ভাবনা। আবার আশায় বুক বেঁধেছে দেশের শ্রমবাজার।

সর্বশেষ খবর