রবিবার, ১২ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

সব খুনেই রহস্যের গোলকধাঁধা

দেড় বছরে নিহত ৪৮, ধরাছোঁয়ার বাইরে খুনিরা

প্রতিদিন ডেস্ক

সব খুনেই রহস্যের গোলকধাঁধা

ধরাছোঁয়ার বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের মূল হোতারা। গত দুই বছর ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হত্যাকাণ্ডের শিকার ইমাম-মুয়াজ্জিন, ব্লগার, লেখক-প্রকাশক, পীর-ফকির, বিভিন্ন ধর্মের পুরোহিত-ফাদার কিংবা বিদেশি নাগরিক। তবে এসব ঘটনার মূল হোতা কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ জঙ্গি হামলাসংক্রান্ত ৩৭টি চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তদন্ত নিয়ে গোলক-ধাঁধায় খোদ তদন্তসংশ্লিষ্টরাই। অন্যদিকে, পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে সারা দেশে শুরু হওয়া জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের প্রথম দিনেই পাবনায় আশ্রমের পুরোহিত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে হত্যায় উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। এর আগে রবিবার চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে তার সন্তানের সামনে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মামলার তদন্তে কেবল ধারণার ওপরই সীমাবদ্ধ থাকছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। উসকানিদাতা, আদেশদাতা কিংবা মূল হোতাদের গ্রেফতার করা সম্ভব না হলে এসব টার্গেট কিলিং বন্ধ হবে না। রহস্যেই থেকে যাবে পুরো ঘটনা। তারা আরও বলছেন, মূল হোতাদের শনাক্ত করতে না পারা অবশ্যই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ব্যর্থতা। এ দায় এড়াতে পারে না গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও। নইলে মূল হোতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে না কেন? অপরাধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযানটি কঠোর এবং আরও শক্তিশালী করতে হবে। তবে অবশ্যই এর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকতে হবে খোদ পুলিশ সদর দফতরকে। বিভিন্নভাবে এসব অপারেশনের মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। নইলে অপারেশনকে কেন্দ্র করে অসৎ সদস্যদের নানা ধরনের অনিয়ম এবং অন্যায় কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিতে হবে পুলিশবাহিনীকে। তিনি আরও বলেন, অভিযান যেন কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রতিশোধের জন্য না হয়। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেই অভিযান পরিচালনা করতে হবে। জানা গেছে, জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন মাত্রায় সক্রিয় হওয়ার পর গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে ৪৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৪৮ জন। যদিও ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার মাধ্যমেই শুরু হওয়া ঘাতকদের কিলিং মিশন ধারাবাহিকভাবেই চলছে। বেশির ভাগ ঘটনায়ই দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের কথিত বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। যদিও বাংলাদেশ সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, দেশে আইএস বা আল-কায়েদার কোনো সাংগঠনিক অবস্থান নেই। দেশীয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (বর্তমান নাম আনসার আল ইসলাম) সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে অনেক ঘটনায়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গিসংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর অনেক মামলায় আসামি গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। তাদের অনেকের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও আদায় করা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে মূল হোতা, উসকানিদাতা কিংবা নির্দেশদাতা কে বা কারা— এ বিষয়ে তথ্য আদায় করা সম্ভব হয়নি। গ্রেফতারকৃতদের কেউ কেউ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তবে চার্জশিট দিতে দেরি হচ্ছে কেন? জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তাদের উত্তর : যে কোনো মামলার চার্জশিট দিতে নানারকম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। এসব সম্পন্ন না হওয়ায় চার্জশিট দিতে বিলম্ব হচ্ছে। এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম এবং ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম সম্প্রতি এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, জঙ্গিরা স্লিপার সেলে বিভক্ত হয়ে কাজ করার কারণে গ্রেফতারের পরও তাদের কাছ থেকে খুব বেশি তথ্য আদায় করা সম্ভব হয় না। কারণ, তারা তাদের ওই সেলের বাকি সদস্যদের ভালো করে চেনেও না। তবে জঙ্গি নির্মূলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা তাদের সর্বোচ্চটা দিতে প্রস্তুত। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে জানা গেছে, জঙ্গি হামলাসংক্রান্ত মামলাগুলোর বেশির ভাগেরই মূল আসামি গ্রেফতার বা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। একজন-দুজন সন্দেহভাজন গ্রেফতারের পরই রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরপরাধ লোকজনকে গ্রেফতারের পর স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগও উঠেছে। পরে খোদ তদন্তসংশ্লিষ্টরা অভিযানে অংশ নেওয়া প্রকৃত কিলারদের ধরার পর নিজেদের ভুল বুঝতে পারছেন। এ অবস্থায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার সমাধান না হওয়ায় চার্জশিট দিতে পারছেন না। সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে উচ্চ পর্যায়ের একটি বিশেষ সভায় আইজিপি দ্রুততর সময়ের মধ্যে তদন্তাধীন মামলাগুলোর চার্জশিট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই বৈঠকে ৩৭টি মামলার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছিল। এর মধ্যে আদালতে মাত্র ৭টি মামলার চার্জশিট জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে একটি মামলার বিচারকাজও সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে, পুলিশ সদর দফতরের দেওয়া তথ্যের বাইরেও জঙ্গিসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সেসব মামলারও চার্জশিট দূরের কথা, তদন্তের কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেননি তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর গোপীবাগে লুত্ফর রহমান নামে এক কথিত পীর ও তার পাঁচ সহযোগীকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও এ মামলায় চার্জশিট দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একই অবস্থা ওই বছরের ৮ আগস্ট খুলনার খালিশপুরে কথিত পীর তৈয়েবুর রহমান ও তার কিশোর ছেলে নাজমুম মনির হত্যাকাণ্ড ঘটনারও। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজাবাজারে সংঘটিত মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনারও কোনো কিনারা হয়নি। পুলিশ সদর দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩৭টি জঙ্গিসংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনার যে বিবরণী দেওয়া হয়েছে তাতে অন্তত ৩টি ঘটনা রয়েছে যেগুলোর কোনো আসামি গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবু পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হয়েছে। এগুলো হলো গত বছরের ৩১ আগস্ট ব্লগার-প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলা, একই দিন লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল হত্যাচেষ্টা মামলা এবং ৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় সংঘটিত কনস্টেবল মুকুল হত্যা মামলা। এ ছাড়া অন্তত ১২টি ঘটনায় সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করা হলেও আদালতে কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি। এসব হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি। তার পরও পুলিশের পক্ষ থেকে রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু দিনের পর দিন পেরিয়ে গেলেও আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারেনি পুলিশ। জানা গেছে, ঢাকায় আরও বেশ কয়েকটি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করা হলেও কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি বা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ব্লগার-লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আট সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু কেউ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দেননি। একই অবস্থা ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল হত্যাকাণ্ডের ঘটনারও। এ ঘটনায় সাত সন্দেহভাজন গ্রেফতার হলেও কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এ ছাড়া গুলশানে ইতালির নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজন নিজেদের জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। যারা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তারা এখন সেই স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করেছেন। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, অস্ত্রের সরবরাহকারী সোহেল আহমেদ ও মূল হোতা সাবেক কমিশনার কাইয়ূমকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। এ কারণে চার্জশিটও দিতে পারছে না পুলিশ।

রংপুরে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যাকাণ্ডে প্রথমে তার ব্যবসায়িক অংশীদার হীরা এবং বিএনপি ও যুবদলের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিও আদায় করে। এ মামলায় পরে জেএমবির আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারাও নিজেদের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এখন পুলিশ বলছে, ওই ঘটনায় আরও দুজনকে খোঁজা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত এ মামলায় চার্জশিট দেওয়া যাচ্ছে না। সূত্র জানায়, ঢাকার বাইরে পাবনার ঈশ্বরদীতে খ্রিস্টান যাজক লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টা, ফরিদপুরে আলোক সেন নামে একজনকে হত্যাচেষ্টা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলার ঘটনা, রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া মুসলিম জামাতের মসজিদে হামলাসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনারই তদন্ত শেষ হয়নি।

পুলিশ বলছে, এসব ঘটনার কোনোটিতে জেএমবি, কোনোটিতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত বলে তারা নিশ্চিত হয়েছে। এ কারণে রহস্য উদ্ঘাটন দাবি করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পরই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্র—আসকের নির্বাহী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নূর খান লিটন বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যই জঙ্গিরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ওপর হামলা করার সাহস দেখাচ্ছে। এসব ঘটনার নেপথ্য মদদদাতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হলে জঙ্গি তত্পরতা কমে আসবে।

সর্বশেষ খবর