সোমবার, ২০ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

ব্যবসা-বাণিজ্য-বিনিয়োগ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ইসলামের বিধান অত্যন্ত স্পষ্ট। ইসলাম নির্ভেজাল এবং পারস্পরিক কল্যাণ ও সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যবসা-বাণিজ্যকে গুরুত্ব সহকারে শুধু অনুমোদনই করে না, বরং সে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনাকে কল্যাণকর আখ্যা দিয়েছে। এতদসংক্রান্ত আল-কোরআনের ভাষ্য এই : ‘আল্লাহ বেচাকেনাকে বৈধ ও সুদকে অবৈধ করেছেন’(২ সংখ্যক সুরা বাকারা, আয়াত ২৭৫)। ‘নগদ আদান-প্রদান ব্যতীত যে কোনো লেনদেন তা ছোট হোক আর বড় হোক মেয়াদসহ লিখতে কোনো বিরক্ত না হওয়া’ (২ সংখ্যক সুরা বাকারা, আয়াতাংশ ২৮২)। ‘পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসায় করা বৈধ’ (৪ সংখ্যক সুরা নিসা, আয়াত ২৯)। ‘সে সব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং সালাত কায়েম ও জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সে দিনকে যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে—’(২৪ সংখ্যক সুরা নূর, আয়াত ৩৭)। ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে বেশি স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (৬২ সংখ্যক সুরা জুম’আ, আয়াত ১০)। ‘আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তত্পর’ (২৪ সংখ্যক সুরা আন নূর। আয়াত ৩৯; ৬ সংখ্যক সুরা আনআম। আয়াত ৬২; ৪ সংখ্যক সুরা নিসা। আয়াত ৬; ৩ সংখ্যক সুরা আল ইমরান। আয়াত ১৯৯)। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘সর্বাপেক্ষা পবিত্র রোজগার হচ্ছে ব্যবসায়ীদের রোজগার। তবে শর্ত হচ্ছে, তারা যখন কথা বলবে তখন মিথ্যা বলবে না। কোনো আমানতের খেয়ানত করবে না। কোনো পণ্য ক্রয় করার সময় সেটাকে মন্দ সাব্যস্ত করে মূল্য কম দেওয়ার চেষ্টা করবে না। নিজের মাল বিক্রয় করার সময় সে মালের অযথা তারিফ করে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করবে না। তার নিজের নিকট অন্যের ধার থাকলে পাওনাদারকে অযথা ঘুরাবে না। অপর পক্ষে, সে কারও কাছে কিছু পাওনা হলে তাকে উত্ত্যক্ত করবে না।’ অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহকে ভয় করে, সত্ভাবে লেনদেন করে এবং সত্য বলে— সেসব লোক ছাড়া কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা গোনাহগারদের কাতারে উত্থিত হবে।’ বস্তত যে সব ক্ষেত্রে ব্যবসার নামে সুদ, জুয়া, ধোঁকা-প্রতারণা ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সেসব পন্থায় সম্পদ অর্জন করা বৈধ ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং হারাম ও বাতিল পন্থা। তেমনি যদি স্বাভাবিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও লেনদেনের মধ্যে উভয় পক্ষের আন্তরিক সন্তষ্টি না থাকে, তবে সেরূপ ক্রয়-বিক্রয়ও বাতিল ও হারাম। ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যবসা বাণিজ্য ও পারস্পরিক লেনদেনে স্বচ্ছতা, বৈধতা ও সুষ্ঠুতা যেসব মৌল নীতিমালার ওপর নির্ভরশীল তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য— (১) পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতার মনোভাব। মুনাফার ক্ষেত্রে একজনের বেশি মুনাফা আর অপরজনের বেশি লোকসানের মনোভাব অবশ্যই পরিত্যাজ্য। (২) পারস্পরিক স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি। জোরপূর্বক সম্মতি আদায় বৈধ বলে গণ্য হবে না। (৩) লেনদেনে উভয় পক্ষকে বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন, প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হতে হবে। অবুঝ, অপ্রাপ্তবয়স্ক, পাগল হলে ব্যবসার চুক্তি সম্পাদন বৈধ সাব্যস্ত হবে না। (৪) কোনো প্রকার প্রতারণা, আত্মসাৎ, ক্ষতি ও পাপাচারের উদ্দেশ্য থাকতে পারবে না। যেসব বস্তুর কারবার হারাম, সে সবের ব্যবসা করা যাবে না। নামাজ শেষ হলে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে’ বেরিয়ে পড়ার নির্দেশনার মধ্যে ব্যবহারিক জীবনের বাস্তব প্রয়োজনীয়তার প্রতি মনোযোগ দেওয়াকে কর্তব্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামে বৈরাগ্য সাধনার স্বীকৃতি নেই। ব্যবহারিক সংসার যাত্রার দাবিকে জীবনের জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। ইবাদত বন্দেগির পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের দাবির প্রতিও দায়িত্বশীল হওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে। যে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের দ্বারা কল্যাণকর পণ্য বা সামগ্রী উত্পন্ন তথা বিপণন হয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, দেশজ সম্পদ উত্পাদনে গঠনমূলক অবদান রাখতে সক্ষম হয় সে ব্যবসা বাণিজ্যকে কল্যাণকর অভিধায় আখ্যায়িত করা চলে। এ জাতীয় বাণিজ্য-বিনিয়োগ-ব্যবসার দ্বারা মানুষের উপকারের সুফল যতদিন কায়েম থাকবে ততদিন বিশেষ সওয়াব হাসিল হতে থাকবে ওই বিনিয়োগকারীর। রসুল (স.) ইরশাদ করেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদগণের সাথী হবে।’ লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর