মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার : ড. মিজানুর রহমান

ক্রসফায়ারের পেছনে কারা জবাবদিহিতায় আনতে হবে

মাহমুদ আজহার

ক্রসফায়ারের পেছনে কারা জবাবদিহিতায় আনতে হবে

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশে যেভাবে বন্দুকযুদ্ধের কাহিনীগুলো সাজানো হয়, তার প্রতি আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে গেছে। এ ধরনের ক্রসফায়ারের মৃত্যু মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সেটিকে আমরা কখনোই গ্রহণযোগ্য মনে করি না। এ ক্ষেত্রে শুধু অভ্যন্তরীণভাবেই নয়, বহির্বিশ্বেও বাংলাদেশ নামক দেশটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। এ কাজগুলো করা থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বিরত থাকতে হবে। এই দুটি ক্রসফায়ারের মৃত্যুর পেছনে কারা ছিল, তাদের জবাবদিহিতায় নিয়ে আসতে হবে। এটা ছোট করে দেখলে চলবে না। এটা সমগ্র রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে বন্দুকযুদ্ধে দুই জঙ্গির মৃত্যু নিয়ে গতকাল দুপুরে রাজধানীর মগবাজারে নিজ কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ড. মিজানুর রহমান খান। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি সত্যিকারার্থে দুই পক্ষ গোলাগুলি করছে বা যুদ্ধ করছে, তাহলে সেটা অন্য ঘটনা। আমরা যে বন্দুকযুদ্ধের কথা বলছি, সেখানে কিন্তু যেনতেন বন্দুকযুদ্ধ নয়। এসব বন্দুকযুদ্ধে যারা নিহত হচ্ছেন, তারা গুপ্তহত্যা করতে গিয়ে মানুষের হাতে ধরা পড়েছেন। যাকে আমরা হাতেনাতে ধরেছি, রিমান্ডে নিয়েছি, তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। এ তথ্যের মাধ্যমে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে প্রকৃত অপরাধী, মূল হোতা, অর্থের জোগানদাতা, পরিকল্পনাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীর মুখোশ উন্মোচন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এই ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ফলে সেই পথটাই বন্ধ হয়ে গেল। এ কারণে জঙ্গিবাদ নির্মূলও থমকে গেল। যে আশার দুয়ার উন্মোচিত হয়েছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।’ এ ধরনের বন্দুকযুদ্ধের সমালোচনা করে ড. মিজান আরও বলেন, ‘কারা এটা করল? সরকার যেখানে চাইছে জঙ্গিবাদকে দ্রুত নির্মূল করতে, তাদের মূলোৎপাটন করতে। এটা তাদেরই কাজ, যারা চায় না সরকারের এ কর্মসূচি সফল হোক। সুতরাং এ ধরনের ক্রসফাসার মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমাদের সমগ্র রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হলো। এ অপরাধকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। আমরা প্রত্যাশা করি, রাষ্ট্র এবং সরকার এ বিষয়টিকে অতি দ্রুত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। যারা যারা এর পেছনে রয়েছে, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।’ গুপ্তহত্যা বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য, এ ব্যাপারে সজাগ থাকা। সবারই দায়িত্ব হচ্ছে, আশপাশে সন্দেহভাজন ব্যক্তির গতিবিধি লক্ষ্য রাখা। তাদের কোনো কর্মকাণ্ড সন্দেহজনক মনে হলে, তা সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে। নাগরিক হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। নাগরিক সমাজ যদি সংগঠিত থাকে, তাহলে কিন্তু অপরাধীরা অপরাধ করতে দুবার ভাববে। তবে যেসব নাগরিক পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করবেন, তারাও যেন প্রশংসিত হন। কোনো কারণে যেন তাদের হয়রানির শিকার না হতে হয়। এটাও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ মানুষ যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গিয়ে উল্টো হয়রানির শিকার হয়, তাহলে তারা কিন্তু তাদের কাছে যেতে চাইবে না। অনেক মানুষ এ কারণেই নিরুৎসাহিত বোধ করে। এটা ভালো নয়।’ ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘পুলিশ জনগণের কাজ করছে। জনগণের বন্ধু। তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে তা প্রমাণ করতে হবে। তাহলেই পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস দৃঢ় হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’ জঙ্গিবাদ নির্মূলে রাজনৈতিক সচেতনতা জরুরি কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ কখনো রাজনীতি হতে পারে না। সন্ত্রাসবাদ কখনো রাজনৈতিক ভাষা হতে পারে না। সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ জঘন্যতম অপরাধ। এটাকে নির্মূল করতেই হবে। এ কারণে রাষ্ট্রকে আমরা বারবার বলছি, প্রয়োজনবোধে তোমরা শক্তি প্রয়োগ করো। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করো। তবে তা এমনভাবে হতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়। আমরা সব সময় এটা বলে থাকি।’ বিশেষ অভিযানের সমালোচনা করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বলা হচ্ছে, ১৯৪ জন জঙ্গি ধরা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ১৩ থেকে ১৪ হাজার। কিন্তু এ ধরনের অভিযান কোনো সভ্য রাষ্ট্রে কাম্য নয়। কারণ ১৯৪ জন ধরতে গিয়ে যদি ১৩ হাজার বা ১৪ হাজার মানুষকে আটকাতে হয়, তাহলে আমার সেই বাহিনীর পেশাগত দক্ষতা নিয়ে বিরাট বড় প্রশ্ন আছে। তারা আসলেই কতখানি দক্ষ, প্রশিক্ষিত, সেটা জনগণের কাছে প্রশ্ন। তাদের হাতে আমাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনগণের ভার দিয়ে রেখেছি। তাদের কাছে আমি আশ্বস্ত বোধ করতে পারি, এই প্রশ্ন কিন্তু থেকে যায়। এইভাবে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ আটক করা, কোনো সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র রয়েছে, আইনের শাসন রয়েছে, সেখানে এটা কাম্য হতে পারে না।’ পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেফতার-বাণিজ্যের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা আরও খারাপ। যখনই নির্বিচারে আটক হয়, তখনই গ্রেফতার-বাণিজ্যের একটি সুযোগও সৃষ্টি হয়। আমরা কিন্তু অনেক আগেই, যখন শুরু হয়, তখনই এই সাবধানবাণী দিয়েছিলাম, তারা যেন এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আমাদের সতর্কবাণী যদি তারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন, যদি আমাদের হেয় না করা হতো, অবজ্ঞা না করা হতো, তাহলে আজকে যারা অভিযোগ করছেন, গ্রেফতার-বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন, তারা তা করতে পারত না।’ সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি কি না—এমন প্রশ্নে ড. মিজান বলেন, ‘আমার মনে হয়, এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্য রয়েছেই। এ নিয়ে কারও কোনো প্রশ্ন নেই। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দর্শন, চিন্তা, কর্মকাণ্ড, তারা মানুষের রাজনীতি করে কি না, সেই পরিচয়টা তাদেরই রাখতে হবে। আমি যদি মানুষের রাজনীতি করি, তাহলে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের সুযোগ নেই। আমার নিজের বিবেকবোধ থেকে, দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করতে হবে। তাইলেই জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ নির্মূল সম্ভব।’ আগামী দিনে সরকারের করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধকে সরকার এখন কীভাবে দেখবে সেটাই বড় কথা। যে ক্রসফায়ারগুলো হয়ে গেল, বিশেষ করে যে দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিহত হলো, গুপ্তহত্যা সম্পর্কে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সাহায্য করতে পারত। তাদের নির্মূল করার মাধ্যমে আমি মনে করি, রাষ্ট্রের জন্য একটি ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা রাষ্ট্র বা সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। এর ওপরই নির্ভর করবে, আমাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে।’

সর্বশেষ খবর