বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

পরিবহনে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

থানার চাঁদা, ফাঁড়ির চাঁদা, বোবা চাঁদা, ঘাট চাঁদা, স্পট চাঁদা; পুলিশ হাতায় মাসোহারা; মালিক-শ্রমিক কল্যাণ ফি; রুট কমিটি-টার্মিনাল কমিটির চাঁদা; টোকেন বাণিজ্য

সাঈদুর রহমান রিমন

পরিবহনে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

ঈদ সামনে রেখে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে নজিরবিহীনভাবে। চাঁদাবাজদের অপতৎপরতা রোধে র‌্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা পরিবহন চাঁদাবাজদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় র‌্যাব-পুলিশের সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়। রাজধানীর শতাধিক পয়েন্টে এ চাঁদাবাজি এখন অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে। একশ্রেণির পরিবহন শ্রমিক, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সম্মিলিত চাঁদাবাজ চক্র। তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে যানবাহন চালক, মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। চাঁদাবাজির অত্যাচার নিয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এসব নিয়ে বিভিন্ন রুটে পরিবহন ধর্মঘট পর্যন্ত করা হয়েছে। তবু চাঁদাবাজির ধকল থেকে রেহাই মিলছে না।

বেবিট্যাক্সি, টেম্পো, বাস, মিনিবাস, ট্রাক থেকে জোরজবরদস্তিভাবে টাকা আদায়ের বিষয়টি বিভিন্ন বিশেষণে চিহ্নিত। সন্ত্রাসীরা সরাসরি ‘চাঁদা’ তুললেও পরিবহন শ্রমিকরা চাঁদা নেয় শ্রমিক কল্যাণের নামে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা টাকা তোলে মাসোহারা হিসেবে। এ ছাড়া আছে বেকার ভাতা, রাস্তা ক্লিয়ার ফি, ঘাট ও টার্মিনাল সিরিয়াল, পার্কিং ফি নামের অবৈধ চার্জ। এমন নানা নামে, নানা কায়দায় চলছে এ চাঁদাবাজির ধকল। সামাল দেওয়ার যেন কেউ নেই। রাজধানীসহ ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে চলছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। সায়েদাবাদ-গাবতলী রুটে চলাচলকারী একাধিক মিনিবাস চালক বলেন, ‘নানামুখী চান্দা-ধান্দার কবলে চালক, মালিক, শ্রমিক সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। যাত্রীরা হচ্ছেন নানা দুর্ভোগের শিকার।’ মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদসহ অন্যান্য বাস ও ট্রাক টার্মিনালের অবস্থা আরও দুর্বিষহ। এসব স্থানে গাড়ি ঢুকতেও লাগে, বেরোতেও লাগে টাকা। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার রুটে চলাচলরত কোচের চালকরা অভিযোগ করে জানান, ইদানীং প্রায়ই কোনো না কোনো স্থানে ‘বেকার ভাতা’ আদায় করা হচ্ছে। নিজেদের বেকার পরিবহন শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে একটি চক্র গাড়িপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে। বিভিন্ন টার্মিনালমুখে অবস্থান নিয়ে তারা রীতিমতো রংবেরঙের স্লিপের মাধ্যমে চাঁদা তুললেও বাধা দিচ্ছে না কেউ। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে চলছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। বিশেষ চেকিং আর মাসোহারা আদায়ের ব্যাপারে তারা রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। রাজধানীর একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে ট্রাকপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা গুনতে হয়। ট্রাকচালকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আগে সাধারণত ঢাকার যে কোনো একজন সার্জেন্টকে ১০০ টাকা দিয়ে স্লিপ সংগ্রহ করলে সিটির মধ্যে আর কোথাও পুলিশকে চাঁদা দিতে হতো না। কিন্তু বর্তমানে এক সার্জেন্ট অন্য সার্জেন্টের স্লিপকে পাত্তা দেয় না, আলাদা আলাদাভাবেই টাকা দিতে হয়।

চলছে চাঁদার মহোৎসব : সায়েদাবাদ টার্মিনাল, গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডসহ রাজধানীর সর্বত্রই পরিবহন সেক্টর ঘিরে চাঁদাবাজির মহোৎসব শুরু হয়েছে। সায়েদাবাদে বিভিন্ন রুট কমিটি ভাঙা-গড়ার নামে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা মেতে উঠেছে মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজিতে। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, সায়েদাবাদ থেকে দেশের পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের ৪৭টি রুটে চলাচলরত দুই সহস্রাধিক যানবাহন থেকে দৈনিক ফ্রিস্টাইলে চলছে চাঁদাবাজি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ ৩২টি রুটে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ কোচ চলে। এ ছাড়া রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল, মহাখালী, উত্তরা, গাজীপুর, টঙ্গী, কালিগঞ্জ, শ্রীপুর, কাপাসিয়াসহ শহর ও শহরতলির অন্যান্য রুটে সহস্রাধিক বাস-মিনিবাসের চলাচল রয়েছে। যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা জানান, কোনো রুটের যানবাহনই চাঁদামুক্ত নয়। বরং চলাচলকারী সব গাড়িকে প্রতি ট্রিপেই ‘নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা পরিশোধের পর টার্মিনাল ছাড়তে দেওয়া হয়’। সে ক্ষেত্রে দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে এবং লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। বিভিন্ন রুটে চলাচলরত গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা জানান, কমিটি দখল ও মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজির অত্যাচারে মালিকরা পথে বসতে চলেছেন। শ্রমিকদের আয়ও কমে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মালিক বলেন, লাকসাম, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন রুটে এখন গাড়িপ্রতি ১২৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদাবাজির শিকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিদিন চাঁদা প্রদানের বিস্তারিত তালিকা তুলে জানান, পরিবহন-সংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নামে ৫০ টাকা, মালিক সমিতি ৮০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ৪০ টাকা, টার্মিনাল কমিটি ২০ টাকা, কলার বয় ব্যবহার বাবদ ২০ টাকা, কেরানির ভাতা ২০ টাকা, মালিক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নামে ৫০ টাকা এবং একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার নামে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। দাউদকান্দি রুটের মিনিবাস চালক লুত্ফর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের বাস শ্রমিক বেলায়েত, হোসেন আলী, খবির মিয়াসহ কয়েকজন জানান, চাঁদা না দিয়ে কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে বাইরে বের করার সাধ্য কারও নেই। চাঁদা নিয়ে টুঁশব্দ করলে নির্যাতনসহ টার্মিনাল ছাড়া হতে হয় বলেও পরিবহন শ্রমিকরা মন্তব্য করেন।

ট্রাক থেকেই কোটি টাকা : বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে পুলিশ। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান এ তথ্য জানিয়ে বলেন, এর প্রতিবাদ করলে হয়রানি আরও বেড়ে যায়। দেশে প্রতিদিন ৯০ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচল করে। এর কোনোটিই পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে চলতে পারে না। বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান জানান, সড়ক বা মহাসড়কে এই ট্রাক চলাচল করতে গিয়ে একেকটি স্পটে ৫০ থেকে ১,০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা যেমন হাইওয়ে পুলিশ নেয়, তেমনি মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামেও আদায় করা হয়। তবে চাঁদাবাজি নিশ্চিত করতে গিয়ে যেসব প্রশাসনিক হয়রানি চালানো হয়, এতে ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পণ্যবাহী ট্রাক ট্রাফিক জ্যামে পড়লে একটি গ্রুপ আছে যারা ভাঙচুরের হুমকি দিয়েও চাঁদাবাজি করে থাকে। রুস্তম আলী খান জানান, বগুড়া থেকে ঢাকা আসতে একটি ট্রাককে অন্তত ১২ জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। এগুলো নির্দিষ্ট চাঁদা। এর ওপর ‘হঠাৎ’? চাঁদাও রয়েছে। গড়ে একটি ট্রাককে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা গুনতে হয়। তারা হিসাব করে দেখেছেন, সারা দেশে পুলিশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান থেকে প্রতিদিন এক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। আর ঈদ-কোরবানি বা কোনো উৎ?সবে এ চাঁদা আদায়ে পুলিশ আরও হয়ে ওঠে বেপরোয়া। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাজধানীমুখী সড়কপথে চাঁদাবাজি বন্ধে সাদা পোশাকে পুলিশের ১৭টি টিম কাজ শুরু করেছে। ঢাকা ও আশপাশে ১৪টি মোবাইল কোর্টও নামছে। এ ছাড়া বিআরটিএর ১৬টি টিম কাজ শুরু করবে দু-এক দিনের মধ্যে।

 

রাজধানীর টার্মিনাল ও সড়কসমূহে চাঁদাবাজি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি বলেন, চাঁদাবাজির স্থান হিসেবে শতাধিক পয়েন্টকে চিহ্নিত করে সেখানে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েনসহ সিসি ক্যামেরা ফুটেজের ভিত্তিতে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া আছে। কতিপয় সার্জেন্ট, ট্রাফিক ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে পুলিশ কমিশনার বলেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর