বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

শক্তিশালী সংগঠনের চেয়ে পরনির্ভরশীলতা বাড়ছে

নূরে আলম সিদ্দিকী

শক্তিশালী সংগঠনের চেয়ে পরনির্ভরশীলতা বাড়ছে

গেল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ২৩ জুন রাজধানীর স্বামীবাগের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) জন্ম। কমিটি গঠন করা হয়েছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে (টাঙ্গাইল) সাধারণ সম্পাদক করে। প্রসূতিলগ্ম থেকেই দলটির লক্ষ্য ছিল ধ্রুবতারার মতো একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগের সমস্ত সত্তার স্পন্দন, অনুশীলন উপলব্ধি, এবং মননশীলতা ছিল গণতন্ত্রকেই লালন করার স্থির প্রত্যয়। আজকে ৬৭ বছরের মাথায় এসে বিশ্লেষণ করলে সমস্ত অনুভূতি ব্যথা এবং অব্যক্ত যন্ত্রণায় টনটন করে ওঠে। একটি ভিত্তিহীন আগুনে দহনে দগ্ধ হয় আওয়ামী লীগের যে কোনো অনুরাগী ও গণতান্ত্রিক কর্মীর চেতনা এবং মননশীলতা। কুঁকড়ে কেঁদে ওঠে হূদয়। স্রোতের ধারায় সেই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পরিচালনায় এমনকি জাতীয় সংসদের অভ্যন্তরেও কোথাও গণতান্ত্রিক চেতনার কোনো অস্তিত্ব নেই। যে চেতনায় একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নিরলস সংগ্রাম করে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এবং সত্তরের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরাধীনতার লক্ষ্য ভেদ করে আজকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল। আজ বঙ্গবন্ধু নেই। দীর্ঘদিনের সংগ্রামে অর্জিত গণতন্ত্র আজ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ম্রিয়মাণই নয়, নিস্তব্ধ, নিস্পন্দ। গণমানুষের সংগঠন, স্বাধীনতার সংগঠন মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু— জাতির জনকের সংগঠন আজ মূল্যবোধের অবক্ষয়ে নিমজ্জিত। দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী, প্রশাসন বিধ্বংস্ত, বিচারব্যবস্থাও রুগ্ন। এ অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই জাতি বেরিয়ে আসবে বলে আজকের এই শুভদিনে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করি।

আগে রাজনীতি ছিল মানুষের জন্য। মুজিব ভাই আমাদের রাজনীতি শিখিয়েছেন মানুষকে বুক উজাড় করে দেওয়ার জন্য। আজকের রাজনীতি শুধুই পাওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগ নামের বাতিঘরের উজ্জ্বল আলো এখন খানিকটা হলেও নিষ্প্রভ। একসময় আওয়ামী লীগ বলতে জাতির সমৃদ্ধি আর সম্ভাবনার সোনালি দিন বোঝাত। সেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ধরে রাখতে পারেনি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের গা-ছাড়া ভাবের কারণে দলটির দেখা দিয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতাও। দুবারের ক্ষমতার সাড়ে সাত বছরে মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের সঙ্গে দলটির তৃণমূল নেতাদের এখন যোজন যোজন দূরত্ব। অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব আর গ্রুপিংয়ের কারণে দলটি ক্ষতবিক্ষত। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে দলটির নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের প্রধান লক্ষ্য হয়েই যেন দাঁড়িয়েছে আত্মীয়-পরিজনবেষ্টিত হয়ে ক্ষমতার প্রতিপত্তি ধরে রাখতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি, নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য আর সরকারি লাভজনক কাজ নিজের করায়ত্ত করার নগ্ন প্রতিযোগিতা। আর মন্ত্রী-নেতা-এমপিদের এমন আদর্শহীন কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়েছে দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোতেও। আওয়ামী লীগের ৯৫ ভাগ নেতৃত্ব আজ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ত্যাগী কর্মীরা খসে পড়েছেন মনোনয়নবাণিজ্যের দৌরাত্ম্যে। ত্যাগী-পরীক্ষিত কর্মীদের আজ মূল্যায়ন নেই। উড়ে এসে জুড়ে বসা ব্যক্তিরা এমপি-মন্ত্রীদের প্রিয় মানুষ। নেতারাও এড়িয়ে চলেন কর্মীদের। দূরত্ব বাড়ছে সর্বত্র। মন্ত্রিসভায়ও আওয়ামী লীগের চরম বিরোধীরা আজ প্রচণ্ড দাপুটে। জনগণের আওয়ামী লীগ সেই জায়গায় নেই। শক্তিশালী সংগঠনের চাইতে পরনির্ভরশীলতাই বাড়ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই তো গতকাল (মঙ্গলবার) নরেন্দ্র মোদির ডাকা দুনিয়াব্যাপী যোগাসনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের উপস্থিতি একটা মর্মান্তিক উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর ওআইসিতে যোগ দেওয়ার বিপরীতমুখী কাজ। বঙ্গবন্ধুর তো প্রশ্নই ওঠে না, তার মন্ত্রিসভার সদস্যেরও দুর্নীতির কথা আজও ওঠেনি। অথচ আজ চারদিকে তাকালে কী দেখছি। দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসীই নয়, আওয়ামী লীগের অমলিন অস্তিত্বকেই শেষ করে দিয়েছে। আমরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কাজ করেছি। আমাদের শির ছিল উন্নত। আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার স্থপতি মানতাম। কিন্তু ছাত্রলীগই ছিল স্বাধীনতার কারিগর। তার (বঙ্গবন্ধুর) সাংগঠনিক রাজনৈতিক কারণে অনুচ্চারিত শব্দ আমাদের কণ্ঠে বজ নিনাদে ঘোষিত হতো। কিন্তু আজকে ছাত্রলীগের সেই অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে ফেলা হচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংগঠনকে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ— প্রতিটি সংগঠনকে গণতন্ত্র অনুশীলন করতে হবে। চর্চা ছাড়া গণতন্ত্র কোনো ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত হয় না, ফ্যাসিবাদেরই জন্ম দেয়। আমি আশা করব, আজকে রাজনীতির আকাশে যে ঘনঘোর অমাবস্যা, তা থেকে বেরিয়ে আসতে আওয়ামী লীগ প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চর্চার লক্ষ্যে সহনশীল হবে। প্রতিপক্ষ ২০-দলীয় জোট আজ মৃতপ্রায়। তাই মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধেই দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়ে আওয়ামী লীগ আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। উড়ে এসে জুড়ে বসাদের ভ্রান্ত বাম রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগকে সরিয়ে আনার চেষ্টা দলটির সভানেত্রীকে করতে হবে। প্রবীণ-নবীনের সমন্বয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের হাতে দলের নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে এবং সেটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কাউন্সিলে শুধু সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নয়, পুরো কার্যকরী কমিটি কাউন্সিলেই নির্ধারিত হবে। লেখক : আহ্বায়ক, প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন

সর্বশেষ খবর