শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিরহ কলহে দুই জোট

১৪ দলে আওয়ামী লীগ একাই একশ

রফিকুল ইসলাম রনি

বিরহ কলহে দুই জোট

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকরা এখন আওয়ামী লীগেরই আলোয় আলোকিত। জোটের বাইরে তাদের অনেকেরই নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তি না থাকায় তারা পুরোপুরি আওয়ামী লীগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। তাদের বেশির ভাগই জোটের প্রধান দলটির উচ্ছিষ্ট নিয়েই সন্তুষ্ট। স্বাভাবিকভাবেই বিশাল আওয়ামী লীগের ছায়ায় অবস্থানকারী শরিক দলগুলোর জোটে ভূমিকা রাখার কোনো অবকাশ নেই। ফলে ১৪ দলে আওয়ামী লীগই সব। জোটের যে কোনো কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকেই চটি সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— সব দায়িত্ব পালন করতে হয়। একদিকে জোটে ভূমিকা রাখার মতো সাংগঠনিক অবস্থা নেই তাদের, অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী ও সরকার সমর্থক এমপি হয়ে নিজেদের অবশিষ্ট জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারছে না। সরকারবিরোধী দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের পাশেও শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি এ দলগুলো। ১৪-দলীয় জোটের বাইরে শরিকদের নেই কোনো দৃশ্যমান দলীয় কর্মসূচিও। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও বাম নেতারা এখন কথা বলতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের সুরে। আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ছাড়া পৃথক কর্মসূচিতে নেই তারা। সাম্প্রতিক গুপ্তহত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণসহ বিভিন্ন ইস্যুতেও দুটি দল ছাড়া অন্য দলগুলোর কার্যক্রম দেখা যায়নি। বরং নিজেদের মধ্যে কোন্দল উপকোন্দল সৃষ্টি করে ক্রমে ছোট হয়ে পড়ছে বাম রাজনৈতিক দলগুলো। ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটে রয়েছে সমমনা ১৩টি রাজনৈতিক দল। সূত্রমতে, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকরা নিজস্ব প্রতীক বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল তাদের নৌকা ছেড়ে দেয়নি। পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এককভাবে নৌকা নিয়ে লড়ে আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শরিকরা জোটগতভাবে লড়ার প্রস্তাব দিলেও আওয়ামী লীগ তা ফিরিয়ে দেয়। জোটের ভিতরে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তই মানতে হচ্ছে তাদের। ফলে জোটের মধ্যে থাকা বাম দলগুলোর ভিতর-বাহির আওয়ামী লীগের মোড়কেই ঢাকা পড়ে গেছে। বর্তমানে ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি—জেপি, শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদ, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, দিলীপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি—ন্যাপ, ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খানের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট কেন্দ্র, অ্যাডভোকেট এস কে শিকদারের নেতৃত্বাধীন গণ-আজাদী লীগ, জাকির হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, ব্যারিস্টার মো. আরশ আলীর নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী পার্টি, সৈয়দ রেজাউর রশিদ খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল—বাসদ, ছৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক অফিসে ১৪ দলের বৈঠকে যাওয়া ছাড়া অধিকাংশ দলের আর কোনো কার্যক্রম নেই। নেই নিজস্ব কর্মসূচি কিংবা কর্মকাণ্ড। শরিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাসদ (রেজাউর) ও ন্যাপের নেই কোনো অফিসভিত্তিক কার্যক্রম। সাম্যবাদী দলের পল্টন ও গণতন্ত্রী পার্টির কাকরাইল অফিস বেশির ভাগ সময়ই থাকে কর্মীশূন্য। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জেপি বাদে বাকি দলগুলোর কোনো অফিসেরই হদিস পাওয়া যায় না। চলমান ইস্যুতে শরিক জোটের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে সক্রিয় দেখা যায়। পার্টি অফিসের সামনে বা প্রেসক্লাব এলাকায় মাঝেমধ্যে বিক্ষোভ সমাবেশ ও পথসভা করতে দেখা যায়। তবে বিগত ৭ বছরে দল দুটির কর্মী সংগ্রহেও ভাটা পড়েছে বলে জানিয়েছেন জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারাই। ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক বলেন, সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সক্ষমতা মাপার কোনো মাপকাঠি নেই। আমরা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ১৪ দল গঠন করেছিলাম। সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে কি হয়নি সেটা পরের বিষয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয়। জোটে বিলীন হওয়ার প্রশ্নই আসে না। ১৪-দলীয় জোট আওয়ামী লীগের আলোয় আলোকিত হলেও শরিক দলগুলোরও নিজস্ব আলো রয়েছে তা যতই ম্রিয়মাণ হোক না কেন।

জোটের শরিকরা যত কথাই বলুক না কেন, শুধু কেন্দ্রে নয়, কেন্দ্রের বাইরেও তৃণমূলে স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে ধরাশায়ী তারা। উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গ না পেয়ে ভোটে অনেকটাই কোণঠাসা তারা। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি, জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগ থাকলেও বাম দলের প্রার্থীরা মুখ খুলতে পারেননি। বিএনপি-জামায়াত মোকাবিলায় অনেকেই আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলতেও বাধ্য হয়েছেন। সংখ্যার হিসাবেও এ জোটে ১৪টি দল নেই। রয়েছে ১৩টি রাজনৈতিক দল। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বামপন্থি ১১ দল, জাসদ ও ন্যাপের যৌথ সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ১৪ দল। ২০০৫ সালের শেষের দিকে জাতীয় পার্টিসহ ধর্মভিত্তিক কিছু দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্যের কারণে ১১ দল থেকে গণফোরাম, সিপিবি ও বাসদ বেরিয়ে যায়। এরপর দুই টার্মের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও পুনর্গঠিত হয় ১৪ দল। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে এখনো আবার জোটের সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ) ১৪ দলের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী ইস্যুতে তাদের সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। যে কোনো সময় নাজমুল হুদার এ জোট ১৪-দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন আছে।

গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টির আহ্বায়কই এ দলের একমাত্র কাণ্ডারি। নেই অফিস বা কোনো কমিটি। বাসদের একাংশও চলছে একইভাবে। জোট দূরের কথা দলের নিজস্ব কর্মসূচি নেওয়ার বা পালন করার মতো নেই কোনো সাংগঠনিক শক্তি। অ্যাডভোকেট এস কে শিকদারের নেতৃত্বাধীন গণআজাদী লীগ রাজধানীর মালিবাগের সাইনবোর্ড-সর্বস্ব একটি অফিস ব্যবহার করলেও দৃশ্যমান কার্যক্রম নেই। জোটের একমাত্র ইসলামী দল বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এ দলটির অবস্থান। রাজপথে জোরালো কর্মসূচিতে দেখা না গেলেও দলটির মহাসচিব এম এ আউয়াল দাবি করেছেন যে, কেন্দ্রীয় ১৪ দল ঘোষিত কর্মসূচি ছাড়াও তারা বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে প্রায় কর্মসূচি পালন করে থাকেন। গণতন্ত্রী পার্টির দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুর রহমান সেলিম ও অধ্যাপক ডা. শহিদুল্লাহ সিকদার বলেন, ‘আদর্শিক জোট হিসেবে আমরা ১৪ দলে রয়েছি। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির বাইরেও দ্রব্যমূল্য, তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, গুপ্তহত্যা, সংখ্যালঘুদের নির্যাতনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আমরা কাজ করছি, মাঠে রয়েছি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর