শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

চাঁদে মানুষ পাঠাতে সক্ষম ভারত সেকেলে চিন্তার ধারক?

কুলদীপ নায়ার

চাঁদে মানুষ পাঠাতে সক্ষম ভারত সেকেলে চিন্তার ধারক?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তার দুই বছরের শাসনের জন্য মার্কস দেওয়ার ভার যদি আমার ওপর থাকত তাহলে তাকে আমি ১০-এর মধ্যে ৪ দিতাম। এর বেশি নম্বর তাকে দেওয়া যায় না। কারণ তিনি সরকারিভাবে হিন্দুত্ব কর্মসূচি চালু না করেও চরমপন্থি সংগঠন আরএসএস এবং বজরঙ্গী দলকে মাঠে চরে বেড়াতে দিয়েছেন।

সংকীর্ণ ভাবনা আর উগ্রবাদী কথাবার্তা ছড়ানোর জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) প্রধান মোহন ভগওয়াতকে আকাশবাণী ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। একইভাবে নেহেরু লাইব্রেরির মতো সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নাগপুর অথবা নয়া দিল্লির ঝান্ডেওয়ালানের আরএসএস সদর দফতর যা বলে তা অনুসরণ করা চাই। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেহেরু-আদর্শের অনুরাগী প্রধানদের বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রক্রিয়াটি এখনো চলছে। এমনকি কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলোয় কেন্দ্রীয় সরকার চালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও খুব চাতুরীর সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের বসানো হচ্ছে। মোদির প্রতিদিন নির্দেশনা পাঠানোর দরকার হয় না। বার্তা তো পৌঁছানোই হয়ে গেছে যে, ‘হিন্দুত্বধারার মানসিকতা যত প্রাচীনই হোক তাতে কিছু আসবে যাবে না, একেবারে উপর থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত সবাইকে সাগ্রহে ওই মানস ধারণ করতে হবে।’

দিল্লি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে দাদরি। সেখানে যে হত্যাকাণ্ড হলো তা দেখা যাক। একজন মুসলমানকে উগ্রবাদীরা মেরে ফেলল শুধু এই কারণে যে, তার পরিবার গোমাংস খেয়েছে বলে সন্দেহ হয়েছিল। ওরা একজনকে খতম করে সন্তুষ্ট নয়। লোকটার পরিবারকেও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। ভয়ার্ত মানুষগুলো প্রতিবাদ জানানোরও সাহস করেনি। এ ঘটনা বিশ্বময় কি এই বার্তাই পাঠাল : চাঁদে মানুষ পাঠাতে সক্ষম দেশ ভারত সুপ্রাচীন ধারণার বশবর্তী হয়ে গোমাংস খাওয়াকে পাপ মনে করে? যারা নিজেদের সেক্যুলারিস্ট বলে দাবি করেন তাদের নীরবতাও খুবই দুঃখজনক। জাপানিরা ‘কোবে বিফ’ নামে অত্যন্ত মজাদার গোমাংস উৎপাদন করে। এজন্য মোদি যদি আগামী দিনে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জাপানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার অনুমতি দেন, তখনো কি এই বুক-চাপড়ানো সেক্যুলারিস্টরা চুপ মেরে থাকবেন? ভারত-শাসিত হয় সংবিধান ভিত্তিতে; এ দেশ হিন্দুরাষ্ট্র নয়, হিন্দুত্বপন্থিরা এটা অনুধাবন করেন না। জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু, ২০ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। সংবিধান এদের সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে। এদের নিয়েই হয়েছে প্রজাতন্ত্র। মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ অর্থাৎ আমরা সম্মিলিতভাবে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাব। তার স্লোগান ঠিকই ছিল। কিন্তু পরে মনে হয় তিনি ও তার দল বিজেপি পথ হারিয়ে ফেলেছে। আজ তারা পছন্দ করুন বা নাই করুন, তাদের সরকার বিশেষ একটা চিন্তাধারার— অসহিষ্ণু ভারত, যার মধ্যে রয়েছে হিন্দুত্বের ব্যঞ্জনা— প্রতিনিধিত্ব করছে। বিজেপির থিঙ্কট্যাঙ্ক সম্ভবত মনে করে যে সমাজকে বিভক্ত করে তারা বেশি ভোট জয় করবেন। আগামী বছরের গোড়ার দিকে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন। সেজন্য বজরঙ্গী দল পরিবেশ তপ্ত করতে শুরু করেছে। তারা বিভিন্ন শহরে ঘন ঘন মহড়া দিচ্ছে, লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্র হাতে সমাবেশ করছে।

এটা পুলিশবাহিনীর সমান্তরাল বাহিনীর মতো আচরণ। উত্তরপ্রদেশে অ-বিজেপি সরকার ক্ষমতায়। তা সত্ত্বেও সেখানে লাঠির ব্যবহার শেখানোর জন্য বজরঙ্গীর নতুন সদস্যদের প্যারেড হয় সকাল-বিকাল। পাশ্চাত্যের ডানপন্থি দলগুলো যেভাবে মুসলিম আধিপত্যের আতঙ্ক ছড়ায়, সেই একই চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে বিজেপি ও তার মিত্ররা।

আমাদের যে গণতান্ত্রিক কাঠামো তাতে যার যা পছন্দ সে তা খাওয়ার ব্যাপারে স্বাধীন। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। বিশাল এই দেশ ভারত, এখানে প্রতি ৫০ কিলোমিটার অন্তর ভাষা ও পোশাক বদলে যায়। এ দেশে বৈচিত্র্য অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে, বৈচিত্র্যই ভারতের শক্তি। বৈচিত্র্যকে মেনে নেওয়ার কারণেই ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে দেশটির বিভিন্ন ইউনিট সংবদ্ধ হয়ে আছে। জাতীয় মূল্যবোধের মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যাওয়ায় ক্ষমতায় আসতে পেরেছে, এ রকম যারা মনে করেন বিজেপির সেই কট্টরবাদীদের ফের একবার অবস্থাটা ভেবে দেখা উচিত। কংগ্রেসের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলায় ভোটাররা বিকল্প খুঁজছিল, সেজন্য তারা বিজেপিকে একটা সুযোগ দিয়েছে— এ যুক্তির মধ্যে অনেক সত্যতা বিদ্যমান। বংশীয় রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দিতে থাকলে কংগ্রেস নিজেকে ব্যর্থ করেই তুলবে। এ দলটি এখনো পর্যন্ত বুঝতে চায় না যে, রাহুল গান্ধীকে দিয়ে জনচিত্ত জয় সম্ভব নয়। অন্যান্য নেতা যারা আছেন তাদেও চেয়ে সোনিয়া গান্ধী অনেক ভালো করবেন। তিনি ইতালীয় হওয়ায় যে অসুবিধা দেখা দিয়েছিল কালক্রমে তা দূরীভূত। এখন জন্মসূত্রে ভারতীয়দের মতোই তিনি ভারতীয় হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, কংগ্রেস তার ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ফেলেছে। তাই সোনিয়ার দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ খুবই সামান্য। সন্দেহ নেই যে, বিজেপি রাজনীতির হিন্দুয়ায়ন ঘটিয়েছে। কিন্তু জাতি হিসেবে ভারতীয়রা মূলত বহুত্ববাদী। এ বিষয়ে বিজেপি সচেতনই মনে হয়। কারণ আলামত দেখা যাচ্ছে যে, দলটি মধ্য ডানপন্থা ছেড়ে মধ্যপন্থার দিকে ঝুঁকতে চাইছে। বিজেপি দল হিসেবে যে অনগ্রসর চিন্তার, তার কারণ দলটির ক্যাডাররা আরএসএস থেকে আসা। হতে পারে যে, এজন্যই সরকার অভ্যন্তরে কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটেনি। আরএসএসের আদর্শ অপছন্দ করা যেতে পারে, কিন্তু সংগঠনটি সততার ওপর যে জোর দেয়, তাতে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও শাসনকার্যে তাদের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে মানুষের বিরাগ অনস্বীকার্য। এমনকি শীর্ষস্থানীয় আমলাদের যোগ্যতাও বিচার করা হয় হিন্দুত্ব আদর্শের সঙ্গে তাদের কার কতটা মাখামাখি সেই আলোকে। মোদি নিজেই আরএসএসের প্রচারক ছিলেন। আরএসএস নেতৃত্বের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্য এখনো তিনি নিয়মিত নাগপুরে যাতায়াত করেন। ওখান থেকে যেসব আইডিয়া তিনি নেন তার প্রতিফলন ঘটে তার সরকারের প্রণীত নীতিমালায়। এর ফলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বুননে চিড় ধরে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে উগ্রবাদী গ্রুপগুলো মাথাচাড়া দেয়। অবস্থাটা ক্ষণকালের, এটাই আমি আশা করি। কিন্তু যতদিন অবস্থাটা চলতে থাকবে ততদিন দেশের সন্তানরা ভারতের ওপর ঘন ছায়াপাতকে চেয়ে চেয়ে দেখবে। এটা খুবই দুঃখজনক। দেশের সংবিধানের মূল কাঠামো যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, আশা করি, সেজন্য নরেন্দ্র মোদি তার নীতিমালার পুনর্বিন্যাস করবেন।

সর্বশেষ খবর