রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ৬৮ কারাগার

মোস্তফা কাজল

নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ৬৮ কারাগার

জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতার সাড়ে ১১ হাজার নতুন বন্দীকে জেলখানার সেলের বাইরে বিভিন্ন গোডাউন, বারান্দা ও রান্নাঘরে গাদাগাদি করে ঠাঁই করে দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের ৬৮টি কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা পড়েছে ঝুঁকিতে। ছোট কারাগারগুলোতে বন্দীদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্ত্রবাজ ক্যাডারদের ঠাসাঠাসি করে রাখতে হচ্ছে। এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে বন্দী অদল-বদল করে নিরাপত্তা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা চলছে। তবে ধারণক্ষমতার আড়াই থেকে তিনগুণ অতিরিক্ত বন্দীর বিপরীতে কারারক্ষীসহ অন্যান্য জনবল না বাড়ায় খোদ কারা কর্তৃপক্ষ চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে। গতকাল সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রধান ফটকসহ আশপাশে শত শত মানুষের ভিড় নেই। কারারক্ষীরা তীক্ষ দৃষ্টিতে দায়িত্ব পালন করছেন। কাউকেই কারাগারের সামনে দাঁড়াতে দিচ্ছেন না। সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের অধিকাংশ কারাগারে সাধারণ সময়েই ধারণক্ষমতার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি বন্দী থাকে। এর ওপর গত সপ্তাহের অভিযানে ১৪৫ জন জঙ্গিসহ ১১ হাজার ৬৮৪ জনকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। তাই কারাভ্যন্তরের বিভিন্ন গোডাউন, বড় সেলগুলোর বারান্দা, এমনকি যেসব সেলের বাথরুমগুলো বড় সেগুলো পরিবর্তন করে হাজত বানানো হয়েছে। কারারক্ষীসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে। এর পরও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা দুরূহ হয়ে পড়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে ছোট-বড় কারাগার আছে ৬৮টি। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার। দুটি হাই সিকিউরিটি। বিভিন্ন জেলা সদরে ছোট কারাগার আছে ৫৫টি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঊর্ধ্বতন এক কারা কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্ন কারাগারে আগে থেকেই বিপুলসংখ্যক জঙ্গি সদস্যদের পাশাপাশি জামায়াত-শিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার ও টপটেররসহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরা আটক রয়েছে। তাদের জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি। অথচ সে ব্যবস্থা দূরে থাক, বন্দীর সংখ্যা অনুযায়ী কারারক্ষীই বাড়ানো হয়নি। এমনকি সিংহভাগ কারাগারেই বরাদ্দকৃত জনবল নেই। এর ওপর অতিরিক্ত সাড়ে ১১ হাজার বন্দীর তাল সামলানো সীমিত কারারক্ষীর পক্ষে দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ কারাগারে সাত হাজারেরও বেশি বন্দী আছে। ফলে অতিরিক্ত চাপ সামলাতে সপ্তাহে এক দিন এক-দেড় হাজার বন্দী কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। তবে অতিরিক্ত বন্দী থাকায় কারাগারের নিরাপত্তা কোনো ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে কি না এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি এই কারা কর্মকর্তা। প্রসঙ্গত, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ধারণক্ষমতা দুই হাজার ৬৮৪ জন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগারের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দীদের অনুমোদিত ধারণক্ষমতা ৮৩ জনের হলেও সেখানে রয়েছে এক হাজার তিনজন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারেও ঠাঁই নাই ঠাঁই দশা। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার বন্দীকে পাহারা দেন গড়ে মাত্র ৪০ থেকে ৫০ জন কারারক্ষী। এর ওপর গত সাত দিনে বিপুলসংখ্যক নতুন বন্দীকে গাদাগাদি করে কারাগারের বিভিন্ন স্থানে ঠাঁই করে দেওয়ায় নিরাপত্তাব্যবস্থা অনেকখানি নাজুক হয়ে পড়েছে। কারাগারের নিরাপত্তায় সহায়তার জন্য তারা ইতিমধ্যে র‌্যাব ও পুলিশকে চিঠি দিয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। কারাগার সূত্র আরও জানায়, ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা কারাগারকে কেন্দ্রীয় কারাগারে রূপান্তর করা হয়। ধারণক্ষমতা ছিল ৭০০ বন্দীর। এরপর দুই দফায় এর আয়তনও বাড়ে। সঙ্গে বাড়ে বন্দীর সংখ্যা। কিন্তু সে তুলনায় কারারক্ষী বাড়েনি। অথচ বন্দীদের পাহারা দেওয়া ছাড়াও তাদের বড় একটা অংশকে বন্দীদের আদালতে আনা-নেওয়া, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ ছাড়া প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নানা কাজেও তাদের সহযোগিতা করতে হয়। ফলে বন্দীদের পাহারায় প্রতি শিফটে ৫০ জনের বেশি কারারক্ষী নিয়োগ করা সম্ভব হয় না কর্তৃপক্ষের। বর্তমানে তিনশর বেশি শিবিরের নেতা-কর্মী আছেন কারাগারটিতে। এ ছাড়া রয়েছে জেএমবিসহ বিভিন্ন সংগঠনের ২০ জনের বেশি জঙ্গি। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে এরা যাতে বন্দীদের উসকানি দিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সেদিকেও নজর দিতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। তাই প্রয়োজনের তুলনায় জনবল অনেক কম থাকায় প্রত্যেককেই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এসব কারাগারের কোনটিতে কত বন্দী রয়েছে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষ তা জানাতে না চাইলেও প্রতিটিতেই ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বলে নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। অতিরিক্ত বন্দীর কারণে কারাগারের নিরাপত্তাঝুঁকি থাকার ব্যাপারেও কারা অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দেশের ৬৮টি কারাগারে আটক ব্যক্তিদের স্বজন ও কারা সূত্রে জানা যায়, একুশে আগস্ট, দশ ট্রাক অস্ত্র, কিবরিয়া হত্যা, বিডিআর বিদ্রোহ, যুদ্ধাপরাধ মামলায় আটক হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কারান্তরীণ রয়েছেন বিরোধী জোটের ২০ প্রথম সারির নেতা। এ ছাড়া দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইর সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইর সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ ও উপ-পরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন। বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ২০০৯ সাল থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বিডিআর জওয়ান কারাগারে আটক রয়েছেন। এদিকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী রয়েছেন বিএনপি, সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের প্রায় সাড়ে আট হাজার নেতা-কর্মী। এ ছাড়া হিযবুত তাহরিরের প্রধানসহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের তিন হাজারের মতো নেতা-কর্মী কারাগারে অবস্থান করছেন। সূত্র জানায়, অতিরিক্ত বন্দীর চাপে কারাগারগুলো শুধু নিরাপত্তাঝুঁকিতেই পড়েনি, কারাগারের সার্বিক পরিবেশও এখন অত্যন্ত নাজুক। অতিরিক্ত চাপে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বন্দীরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কারা হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা দিতে না পারায় তাদের অনেককেই বাইরের হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। এতে নিরাপত্তাঝুঁকি আরও এক ধাপ বেড়েছে। কারণ বাইরের হাসপাতালে আনা-নেওয়ার সময় সন্ত্রাসী বন্দীরা কেউ কেউ বিভিন্ন কৌশলে বাইরের সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। সূত্র জানায়, কারাভ্যন্তরে অঘটন ঘটানোর ব্যাপারে পলিটিক্যাল ক্যাডারদের নিয়েই তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে। কারণ কারাবন্দী অন্য অপরাধীরা পরস্পর অপরিচিত ও অসংগঠিত। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক ক্যাডারদের মধ্যে পরস্পরের জানাশোনা রয়েছে এবং তারা সুযোগ পেলেই সংগঠিত হয়ে কোনো অপতত্পরতার উদ্যোগ নিতে পারে। কারা অধিদফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কষ্ট করে হলেও ধারণক্ষমতার দেড়গুণ বন্দীও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু এ সংখ্যা যখন আড়াই থেকে তিনগুণে গিয়ে দাঁড়ায়, তা রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সর্বশেষ খবর