রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিচ্ছিন্নতার পক্ষে স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই

আলী রীয়াজ

বিচ্ছিন্নতার পক্ষে স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই

ব্রিটেনের গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষের বিজয়ের প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে, বিশ্ববাজারে তার আরও প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে আগামী কয়েক দিনে। এই ভোটের ফলাফলের কারণে আজই ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরে চলে যাচ্ছে এমন নয়। এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরে তা কার্যকর হবে। দুই বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। কিন্তু এর ফলে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সূচনা হলো সেটি কোন পথে অগ্রসর হবে তা আসলে কেউই জানেন না। জানেন না তার কারণ, যারা ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে প্রচার করেছেন তারা সুস্পষ্ট কোনোরকম পরিকল্পনা তুলে ধরেননি; আর এর কোনো অতীত উদাহরণ নেই যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে। এ অনিশ্চয়তার প্রথম ধাক্কাটি অবশ্যই আমরা দেখব ব্রিটেনের অর্থনীতিতে। কিন্ত সেটা কেবল ব্রিটেনেই সীমিত থাকবে না। ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই ভোট কনজারভেটিভ দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়ছে; সামনের কঠোর ও অনিশ্চিত দিনগুলোতে সামান্য হলেও স্থিতিশীলতার স্বার্থে অক্টোবর পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করবেন। লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের জন্যও এই ফল সুখকর নয়। কিন্তু ক্যামেরনের জায়গায় দায়িত্ব নিতে কেউ এগিয়ে আসবেন কিনা তাও দেখার বিষয়। সে ক্ষেত্রে লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন হচ্ছেন সম্ভাব্য বিকল্প। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, এ ফলাফল অত্যন্ত সামান্য ব্যবধানের, ফলে যিনিই দায়িত্ব নিন বা থাকুন তাকে এটা মনে রাখতে হবে।

এই ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। এখন ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্তের পরে তারা কি আলাদা হওয়ার দাবি আবার তুলতে পারেন? সে রকমটা মনে করা ভুল হবে না। তার মানে কি এই যে, এই গণভোট ঐক্যবদ্ধ ব্রিটেনের অবসানের প্রথম পদক্ষেপ? এই গণভোটের প্রচারে এবং সম্ভবত বিজয়ের পেছনেও কাজ করেছে অভিবাসনের প্রশ্ন। তার অর্থ হচ্ছে, এখন ব্রিটেনে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব আরও চাঙ্গা হবে। এর একটি সুস্পষ্ট বর্ণবাদী রূপ তৈরি হওয়ায়ই স্বাভাবিক। এ আশঙ্কা সত্য হলে তার প্রথম শিকার হবেন অশ্বেতাঙ্গরা। অতীতে দক্ষিণ এশিয়ানরই এ ধরনের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার বই ওংষধস ধহফ ওফবহঃরঃু চড়ষরঃরপং ধসড়হম ইত্রঃরংয-ইধহমষধফবংযরং : অ খবধঢ় ড়ভ ঋধরঃয, গধহপযবংঃবৎ : গধহপযবংঃবৎ টহরাবত্ংরঃু চত্বংং, ২০১৩—এ। ব্রিটেনের এই ফল যে, ইউরোপের অন্য দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে তাও অনুমেয়। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা একে পুঁজি করে ইউনিয়ন থেকে বেরোবার দাবি তুলবেন। আমরা জানি যে, গত প্রায় এক দশকে গোটা ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থি দলগুলো শক্তি সঞ্চয় করেছে (দেখুন নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ২২ মে, ২০১৬)। এ দলগুলো এখন আরও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করবে। এর প্রতিক্রিয়া কি আটলান্টিকের অপর পাড়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পড়তে পারে? ইতিমধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান দেখতে পাচ্ছি, যার বক্তব্য ‘ব্রেক্সিটের’ সমর্থকদের চেয়ে ভিন্ন নয়। অভিবাসীবিরোধী মনোভাবকে শক্তিশালী করার চেষ্টা ট্রাম্পের প্রচারণার প্রধান দিক। ফলে এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, এতে তিনি শক্তিশালী হবেন। তবে এ প্রচেষ্টার সাফল্য নির্ভর করছে ডেমোক্রেটিক পার্টির ওপরও। হিলারি ক্লিনটন ও ডেমোক্রেটিক পার্টি যদি দেখাতে পারে যে, এ ধরনের ‘আইসোলানিস্ট’ (একা চল) পদক্ষেপের পরিণতি ভালো হয় না যেমন ব্রিটেনের জন্য হচ্ছে না তবে তার ফল উল্টোও হতে পারে। বাংলাদেশে যারা আছেন তারা নিশ্চয় বুঝতে চাইবেন এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে কী হবে। এর কোনো রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে পড়বে বলে মনে হয় না। তবে অবশ্যই এর অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের ওপরে হবে। কেননা বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোয় শুল্কমুক্ত যে সুবিধা পায়, তার আওতায় ব্রিটেনে রপ্তানি করে। ইউনিয়নে মোট রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে কমপক্ষে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয় ব্রিটেনে (২০১৩-১৪ সালের হিসাব এটি)। ব্রিটেন বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। আগামীতে সেখানে আলাদা করে আলোচনা করে রপ্তানির পথ তৈরি করতে হবে। পাউন্ডের মূল্যমান হ্রাস হলে আয়ের পরিমাণ কমবে। বাংলাদেশে যেসব বিদেশি বিনিয়োগ আসে তার মধ্যে ব্রিটেন হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। তার ওপরও প্রভাব পড়বে বলেই ধারণা করা যায়। ব্রিটেনের গণভোট কেবল ব্রিটেনকেই এক অনিশ্চিত যাত্রায় ঠেলে দিয়েছে তা নয়, তার সহযাত্রী সারা পৃথিবী। লেখক : অধ্যাপক, ইলিনয় স্টেট, ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

সর্বশেষ খবর