সোমবার, ২৭ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

ছিনতাইকারী ভয়ঙ্কর

ঈদ সামনে রেখে বেপরোয়া চক্র

সাখাওয়াত কাওসার

ঘটনা-১ : ক্যান্সার আক্রান্ত মা তসলিমা বেগম (৬০) মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। মায়ের রক্ত কেনার জন্য ১ জুন সকাল ৯টার দিকে ২৫ হাজার টাকা নিয়ে রাজধানীর মুগদার মান্ডা থেকে ঢামেক হাসপাতালে ফিরছিলেন ছেলে বিপ্লব। লেট্টা ফকির নামক জায়গায় পৌঁছতেই স্থানীয় মুরাদ নামের বখাটের নেতৃত্বে আরও তিনজন বিপ্লবের পথ রোধ করে। তার সঙ্গে থাকা টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি তার মায়ের বিষয়টি খুলে বলেন। কিন্তু বখাটেদের পাষাণ হূদয় এতটুকু গলেনি। একপর্যায়ে বিপ্লবের হাতে-পায়ে ছুরিকাঘাত করে তার সঙ্গে থাকা মায়ের রক্ত কেনার ২৫ হাজার টাকা এবং মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নেয় বখাটেরা।

ঘটনা-২ : বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে পাঁচ বছরের সন্তান সুরাইয়া আক্তার প্রিয়াকে নিয়ে ভাড়া করা প্রাইভেট কারে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে খিলগাঁওয়ের বাসায় ফিরছিলেন গৃহবধূ শান্তা বেগম। বাড্ডা এলাকায় পৌঁছলে চালক রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে তার পূর্বপরিচিত আরও দুজনকে ওই গাড়িতে ওঠায়। তাদের গাড়িতে ওঠানোর প্রতিবাদ করলে শান্তা বেগমকে চালক বলতে থাকে, ‘আপা, সবারই মা-বোন আছে। ভয় পাইয়েন না।’ কিছুদূর এগোতেই শান্তা ও তার শিশুসন্তানকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তারা। একপর্যায়ে শিশু প্রিয়ার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তার মায়ের কাছে থাকা এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা ও গলার সোনার চেন ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এরপর আফতাবনগর এলাকায় ছিনতাইকারীদের একজন শান্তার মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে চলন্ত গাড়ি থেকে তাদের ফেলে দ্রুত পালিয়ে যায়। ভুক্তভোগী শান্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ছিনতাইকারীদের একজনের মুখে লম্বা দাড়ি ছিল। অন্যজনের মাথায় চুল কম ছিল। গাড়ি নম্বর ছিল ঢাকা মেট্রো-গ ৮৬৯৭। এ তো গেল মাত্র দুটি ঘটনা। রাজধানীতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ভয়ঙ্কর ছিনতাইয়ের ঘটনা। ঈদ সামনে রেখে নগরবাসীর জানমালের নিরাপত্তায় চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি ঠেকাতে প্রয়োজনে পুলিশ গুলি ছুড়বে, বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার কঠোর হুঁশিয়ারির পরপরই প্রায় একই সময়ে রাজধানীতে ঘটে ভয়ঙ্কর দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনা। এ দুটি ঘটনার পর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন নগরবাসী। এ যেন ডিএমপি কমিশনারকে ছিনতাইকারীদের পাল্টা চ্যালেঞ্জ! গাবতলীতে এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি প্রতিরোধে প্রয়োজনে পুলিশকে গুলি করতে বলা হয়েছে। এর আগে বুধবার সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলার উপস্থাপিকা শারমিন রমা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে ঈদকে কেন্দ্র করে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে এটা তো নতুন কিছু নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তো সবই জানেন। রাজধানী কটি স্পটে ছিনতাই হয় এ সম্পর্কেও তাদের বিশেষ স্টাডি রয়েছে। এর পরও ছিনতাইকারীদের কেন রোখা যাবে না? এটা অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যর্থতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিকশাযাত্রীর ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি অলিগলিতে দিনের বেলায়ও অস্ত্রধারীদের সামনে পড়ে অর্থকড়ি খুইয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে মানুষকে। যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার ছাদ কেটে মুঠোফোন, জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার ট্যানারি মোড়ে প্রকাশ্যে ফাঁকা গুলি করে আতঙ্ক ছড়িয়ে হঠাৎ ব্যস্ততম রাস্তা জনশূন্য করে ছিনতাইকারীরা। এরপর একটি প্রাইভেট কার থামিয়ে তারা গাড়িতে থাকা আরোহী এক এনজিও কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম মুরাদের পায়ে গুলি করে টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ফিল্মি স্টাইলে পালিয়ে যায়। অদূরেই পুলিশের চেকপোস্ট এবং সেখানে নিয়মিত তল্লাশি থাকার পরও এ ঘটনা ঘটে। ১ জুন টিকাটুলী মোড়ে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী দুই ভাইবোন ইমাজুল হক ও ফারিয়া তাবাস্সুম। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট যাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা রিকশায় সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে যাচ্ছিলেন। ছিনতাইকারীরা ভাই ইমাজুলের পিঠে ছুরিকাঘাত করে তার কাছে থাকা ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ও পাঁচ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। ভুক্তভোগীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উল্টো পুলিশি হয়রানির ভয়ে থানায় অভিযোগ করতে আগ্রহ দেখান না তারা। মূল্যবান সামগ্রী হারিয়েছে উল্লেখ করে তাদের কেউ কেউ সাধারণ ডায়েরিতেই সীমাবদ্ধ থাকেন। এদিকে চলমান পুলিশি অভিযান, চারদিকে কড়া নিরাপত্তা আয়োজন, তল্লাশি-চৌকি, টহল সত্ত্বেও রাজধানীতে হঠাৎ করেই ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন নগরবাসী। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার দিদার আহম্মেদ বলেন, বৃহস্পতিবারের দুটিসহ অনেক ঘটনারই ছায়াতদন্ত করছে ডিবি। হাজারীবাগের ঘটনায় ইতিমধ্যে অনেক দূর অগ্রগতি এসেছে। তবে এ মুহূর্তে সবকিছু বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ডিবির অনেকগুলো টিম ঈদকে কেন্দ্র করে অজ্ঞানপার্টি, মলমপার্টি ও ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে নানামুখী অভিযান শুরু করেছে। এসব বিষয়কে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে নেয় ডিবি। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই ঢাকাসহ সারা দেশে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল, মাদক, অস্ত্র ও জঙ্গিবিরোধী দুটি বিশেষ অভিযান শেষ করেছে পুলিশ। অভিযানে সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানী থেকে গ্রেফতার হয়েছেন ১ হাজার ৭৮ জন। পুলিশের দাবি, এ অভিযানে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যই বলছে, যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন এলাকা, সাতমসজিদ রোডসহ ধানমন্ডির বিভিন্ন নিরিবিলি এলাকা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আগারগাঁও ক্রসিং পর্যন্ত সড়ক, রাতে হাতিরঝিল সড়ক, বাড়িধারা ডিওএইচএস-সংলগ্ন রেললাইন, উত্তরার বিভিন্ন সড়কে ছিনতাই হচ্ছে। এর বাইরে রাজধানীর মার্কেটগুলোর আশপাশে বিভিন্ন বেশে অবস্থান নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। ক্রেতাদের অনুসরণ করে তাদের গতিপথ সম্পর্কে অবহিত করে দিচ্ছে অন্যত্র অবস্থান নেওয়া গ্রুপের অন্য সদস্যদের। এর বাইরে কাকডাকা ভোরে বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনে যাওয়া ঘরমুখো মানুষদের দিকে টার্গেট করছে ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা। এ ব্যাপারে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ঈদকেন্দ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে র‌্যাবের টহল ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এর বাইরেও ছিনতাইকারীদের তালিকা হালনাগাদ করে অভিযান চলছে।

সর্বশেষ খবর