শনিবার, ২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

আবারও সেবায়েত হত্যা

মোটরসাইকেলে এলেন তিনজন, আগের মতোই খুন করে চলে গেলেন

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

আবারও সেবায়েত হত্যা

ঝিনাইদহে খুন হয়েছেন মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস (ইনসেটে)। নড়াইলে তার গ্রামের বাড়িতে গতকাল স্বজনদের আহাজারি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

পুরোহিত হত্যাকাণ্ডের এক মাসের ব্যবধানে এবার ঝিনাইদহ সদরে গোঁসাই শ্যামানন্দ দাস ওরফে বাবাজি (৬৫) নামের মঠের এক সেবায়েতকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শ্যামানন্দ মধুপুর উত্তর কাস্টসাগরা গ্রামের শ্রীশ্রীরাধামদন গোপাল মঠের সেবায়েত। গতকাল সকাল সাড়ে ৫টার দিকে মোটরসাইকেল আরোহী তিন ব্যক্তি মন্দিরের পাশেই তাকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় শ্যামানন্দ পুজোর জন্য ফুল তুলছিলেন। স্থানীয়রা সংকটাপন্ন শ্যামানন্দকে উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার গ্রামের বাড়ি নড়াইলের চাউলিয়া গ্রামে। বাবার নাম কিরণ চন্দ্র। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ, খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনিরুজ্জামান, খুলনা র‌্যাব-৬-এর পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলাম, ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার ও জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আলতাফ হোসেন। এসপি আলতাফ হোসেন বলেন, আজ (শুক্রবার) সকাল সাড়ে ৫টার দিকে শ্যামানন্দ দাস বাবাজি মঠ থেকে বের হয়ে পূজার জন্য ফুল তুলতে মঠের সামনের রাস্তার পাশে আসছিলেন। এ সময় ডিসকভারি ব্র্যান্ডের ১০০ সিসির একটি লাল রঙের মোটরসাইকেলে তিন দুর্বৃত্ত এসে শ্যামানন্দকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত করতে হিন্দু সেবায়েতের মাথা ও ঘাড়ে একাধিক কোপ দেওয়া হয়। যে কৌশলে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, তার সঙ্গে সাম্প্রতিক বিভিন্ন জঙ্গি হামলা ও হত্যার ঘটনার মিল রয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। শিফালী নামে প্রত্যক্ষদর্শী এক মহিলা জানান, প্রতিদিনের মতো পূজার জন্য ফুল তুলতে মঠ থেকে বের হয়েছিলেন শ্যামানন্দ। এ সময় শহরের দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে করে আসা তিন ব্যক্তি শ্যামানন্দকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় কুপিয়ে চলে যায়। মোটরসাইকেলের আরোহীদের মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। মাথায় ছিল ক্যাপ। মাঝের জনের হাতে ছিল একটি রামদা। মঠের কোষাধ্যক্ষ প্রভাস কুমার জানান, ‘শ্যামানন্দের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার মুশুড়িডাঙ্গা গ্রামে। বছর তিনেক আগে তিনি এই মন্দিরে এসে সেবায়েত হন। কারও সঙ্গে তার সমস্যা ছিল বলে আমি শুনিনি।’ এলাকাবাসী জানায়, শ্যামানন্দ দাস পরিবার ত্যাগ করে বৈষ্ণব দীক্ষা নিয়ে মন্দিরে মন্দিরে পূজা-অর্চনার কাজ করে বেড়াতেন। তিনি ঝিনাইদহে এসে সদর উপজেলার শ্রীশ্রীরাধামদন গোপাল মঠ মন্দিরের সেবায়েতের দায়িত্ব নেন। তাকে এলাকার মানুষ বাবাজি বলে ডাকত। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন।

বাঁশের লাঠি ও বাঁশিতে কাজ হয়নি : খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনিরুজ্জামান সম্প্রতি জঙ্গি ও নাশকতাকারীদের রুখতে ঝিনাইদহ নলডাঙ্গা ইউনিয়ন ও শহরের পায়রা চত্বরে সমাবেশ করে জনসাধারণের মধ্যে বাঁশের লাঠি ও বাঁশি বিতরণ করেছিলেন। কিন্তু এই বাঁশ ও বাঁশি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় ঝিনাইদহ সদর থানায় পড়ে আছে। ডিআইজির জনসচেতনতামূলক বক্তব্য শুনে মানুষ দুর্বৃত্ত প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ হয়নি। বরং এ হত্যাকাণ্ডের ফলে নতুন করে ঝিনাইদহের হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরোহিত ও সেবায়েতদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

শোক ও নিন্দা : সেবায়েত হত্যার ঘটনায় শোক প্রকাশ ও নিন্দা জানিয়েছে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ। জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আছাদুজ্জামান আছাদের স্বাক্ষরিত শোক বিবৃতিতে জানানো হয়, দলের পক্ষ থেকে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল হাই এমপি ও সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু শ্যামানন্দ দাসের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে তারা জানিয়েছেন এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পিত একটি হত্যাকাণ্ড। দেশ-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তারা। একই বিবৃতিতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের পক্ষ থেকে শোক জানানো হয়। জেলায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটতে থাকায় উদ্বিগ্ন প্রশাসন গতকাল বিকালে এক জরুরি সভায় মিলিত হয়। সভায় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত, এ নিয়ে চলতি বছর কেবল ঝিনাইদহে একই কায়দায় চারজন ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুকে হত্যা করা হলো। প্রথম ঘটনা ঘটে গত ৭ জানুয়ারি। ওই দিন ঝিনাইদহের সদর উপজেলার বেলেখাল বাজারে নিজ হোমিও চিকিৎসালয়ে খুন করা হয় ছামির আলীকে (৮২)। পরদিন আইএসের নামে দায় স্বীকার করে দাবি করা হয়, খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে ছামির আলীকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ১৪ মার্চ কালীগঞ্জ উপজেলায় শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা আবদুর রাজ্জাক (৪৮) নামের এক হোমিও চিকিৎসককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই হত্যার দায়ও স্বীকার করে আইএস। গত ৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের মহিষারভাগাড় এলাকায় আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনটি হত্যা ঘটনার তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশ দাবি করেছে, আইএস আনন্দ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিলেও ওই হত্যার পেছনে জড়িত ইসলামী ছাত্রশিবির। গাঙ্গুলী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঝিনাইদহ শহর ওয়ার্ড ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি এনামুল হককে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেফতার করা হয়। এনামুল হক ঝিনাইদহ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় হত্যার কথা স্বীকার করেন। তবে এনামুলের পরিবার দাবি করে, ছাত্রশিবির করার অপরাধে জোর করে তার জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে।

সেবায়েতের বাড়িতে আহাজারি, মা নির্বাক : দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত ঝিনাইদহের কাস্টসাগরা রাধামদন গোপাল মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসের গ্রামের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার মুশুড়ি গ্রামে চলছে মাতম। ছেলে হত্যার খবর শুনে মা চারুবালা (৭০) নির্বাক হয়ে গেছেন। স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। অনেকেই শোকে মূর্ছা যাচ্ছেন। নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের মুশুড়ি গ্রামে শ্যামানন্দের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে আশপাশ এলাকা থেকে মানুষ ওই বাড়িতে আসছেন। নিজের কোনো ঘর না থাকলেও তার ভাইয়ের ঘরে বসে আছেন আত্মীয়স্বজনরা। চারদিকে যেন সুনসান নীরবতা। বাড়িতে চলছে আহাজারি। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, শ্যামানন্দ দাস ওই গ্রামের কিরণ সরকারের ছোট ছেলে। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম প্রদ্যোৎ সরকার। দুই বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে ছোট প্রদ্যোৎ সরকার বাল্যকালে ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষার জন্য ছোটবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এরপর বিভিন্ন স্থানে সেবায়েতের দায়িত্ব পালন শেষে তিন বছর আগে ঝিনাইদহের কাস্টসাগরা রাধামদন গোপাল মঠে যান। তিনি ‘দাস’ হিসেবে পরিচিত হন। চিরকুমার শ্যামানন্দ দাস মন্দিরের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। মাঝেমধ্যে নড়াইলের বাড়িতে আসতেন। বাড়িতে এসে পরিবারের সদস্য ও হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মাঝে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন।

শ্যামানন্দের ভাইয়ের স্ত্রী তৃষ্ণা সরকার জানান, ‘বৃহস্পতিবার রাতে ফোনে সর্বশেষ কথা হয়েছে। আজই (শুক্রবার) সকালে শ্যামানন্দের গ্রামের বাড়িতে আসার কথা ছিল। ভোরে মোবাইলে মৃত্যুর খবর পেয়েছি।’ নিহতের বড় ভাই বিশ্বনাথ সরকার বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ধর্মযাজকদের হত্যা করা হচ্ছে। আগের হত্যাগুলোর বিচার হলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত না। এসব হত্যাকাণ্ডে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।’

ঝিনাইদহে একই কায়দায় ছয় মাসে চার খুন : ঝিনাইদহে ছয় মাসে একই কায়দায় চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। একের পর এক এসব হত্যাকাণ্ডের ফলে এলাকাবাসী আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সব হত্যাকাণ্ডের জন্যই জঙ্গিসম্পৃক্ততার কথা বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঝিনাইদহ চরমপন্থিদের এলাকা হিসেবে পরিচিত বলে জঙ্গিরা তাদের হত্যার দায় চরমপন্থিদের ওপর চাপিয়ে নিজেদের আড়ালের চেষ্টা করছে।

পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি খুন হওয়ার পর গ্রামবাসী বলছে, আশপাশের কারও সঙ্গেই তার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিরোধ ছিল না। সবার মনে একই প্রশ্ন, তবে কোন অপরাধে হত্যা করা হলো? চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদরের গান্না ইউনিয়নের কালুহাটি গ্রামে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ছামির আলীকে। তার অপরাধ, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ। এ ছাড়া ১৪ মার্চ কালিগঞ্জে কুপিয়ে হত্যা করা হয় শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী হোমিও চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাককে। ৭ জুন সকালে মন্দিরে পূজা দিতে যাওয়ার সময় গলা কেটে হত্যা করা হলো ৭০ বছর বয়সী পুরোহিত আনন্দ গোপালকে। সবশেষ গতকাল মধুপুর উত্তর কাস্টসাগরা গ্রামে শ্রীশ্রীরাধামদন গোপাল মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস বাবাজিকে (৬৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ফলে জনমনে বিরাজ করছে আতঙ্ক। খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনিরুজ্জামান মনে করেন, সব হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। তাই জঙ্গিদের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ছেন তিনি। বলেন, ‘এগুলো টার্গেট কিলিং বলা যেতে পারে। আমরা অচিরেই তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হব এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে আমরা বদ্ধপরিকর।’ এরই মধ্যে ছামির আলী হত্যার দায়ে চারজনকে এবং রাজ্জাক হত্যার ঘটনায় দুজনকে আটক, পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি হত্যার ঘটনায় এনামুল নামে এক শিবির কর্মীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া আনন্দ গোপাল হত্যার রহস্যও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে দাবি তাদের। ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ বলেন, ‘আগের মামলা দুটির যোগসূত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আনন্দ গোপালের হত্যা মামলার আসামিদের খুঁজে বের করা হবে। চরমপন্থিদের ওপর দায় চাপাতে হত্যার জন্য এ এলাকাকেই বেছে নিয়েছে জঙ্গিরা।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর