শনিবার, ২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

গুলশানে ভয়ঙ্কর হামলা

পুলিশের এসি-ওসি নিহত আইএসের দায় স্বীকার ২৪ বিদেশি হত্যার দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

গুলশানে ভয়ঙ্কর হামলা

জখম পুলিশ সদস্য। ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয় বিজিবি, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য। গুলশানের এই রেস্তোরাঁয়ই হামলা চালানো হয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ার একটি রেস্টুরেন্টে গতরাতে হামলা চালিয়েছে বন্দুকধারী জঙ্গিরা। গুলি ও গ্রেনেডের ভয়ঙ্কর এই হামলায় গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও  বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খান নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬ পুলিশসহ কমপক্ষে ১৮ জন। তাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হামলাকারীরা জিম্মি করেছে অর্ধশতাধিক মানুষকে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিদেশি। রাত সাড়ে ৩টায় রেস্টুরেন্টটি ঘিরে ছিল পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গুলি চালানো হলে জিম্মিদের মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিচ্ছিল সন্ত্রাসীরা। রাত ৮টায় শুরু এ ঘটনা রাত সাড়ে ৩টায়ও অব্যাহত ছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে আরও ভয়াবহ কোনো ঘটনার। আইএসের আমাক নিউজে সর্বশেষ বলা হয়, গুলশান হামলায় এখন পর্যন্ত বিদেশি ও বাংলাদেশিসহ ২৪ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়েছেন। এর আগে বিশেষ বাহিনী সোয়াত দুই জিম্মিকে উদ্ধার করে। তাদের একজন আর্জেন্টাইন ও একজন বাংলাদেশি। তারা হামলার সময় দৌড়ে পাশের ভবনের দেয়ালের আড়ালে চলে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুলিশ রেস্টুরেন্টের  দুই কর্মচারীকে আটক করেছে। ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক। এর মধ্যেই অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শেষ রাতে সেনাবাহিনীর একটি কমান্ডো টিম ঘটনাস্থলে যায়। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে হোয়াইট হাউসে কর্মকর্তারা জরুরি বৈঠকে বসেন। ঢাকায় বিদেশিদের ওপর নির্বিচারে সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার আশঙ্কা করার এক বছরের মধ্যে এ আক্রমণের ঘটনা ঘটল। তবে এই সন্ত্রাসী কারা এ বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, জেএমবি নেতা খালেদ সাইফুল্লাহর নিঃশর্ত মুক্তিসহ তিনটি দাবি করা হয়েছে। জানা যায়, গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশন ও ইউরোপের নাগরিকদের নরডিক ক্লাবের পাশের ভবনে অবস্থিত হলি-আর্টিসান বেকারি, ও’কিচেন রেস্টুরেন্ট ও একটি ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে হয়েছে এই হামলা। রেস্টুরেন্টের কর্মচারী সুমন রেজা উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, রাত ৮টার দিকে বেকারি ও রেস্টুরেন্টটিতে প্রবেশ করে সন্ত্রাসীরা। তাদের একজনের হাতে ছিল তলোয়ার, অন্যদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। তলোয়ার হাতের সন্ত্রাসী আল্লাহু আকবর বলে আক্রমণের নেতৃত্ব দেয়। রেস্টুরেন্টের সামনের খোলা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা অতিথিদের দিকে বোমা ছোড়া হয়। পরে নির্বিচারে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। কর্মচারী সুমনের ধারণা, এ সময় হোটেলে বিদেশি, বাংলাদেশি অতিথি ও কর্মচারীসহ ৪০-৪৫ জন ছিলেন। হামলাকারী ছিলেন কমপক্ষে ১০। গলায় ও বাম বাহুতে গুলিবিদ্ধ মাইক্রোবাস চালক আবদুর রাজ্জাক রানা (৩০) জানান, ‘সাড়ে ৮টার কিছু আগে চারজন জাপানিকে নিয়ে ওই রেস্টুরেন্টে যাই। তারা রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলে তাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিল। এ সময় হঠাৎ শরীরে দুটি গুলি লাগে।’ পুলিশ কনস্টেবল প্রদীপ সাংবাদিকদের জানান, ‘রেস্টুরেন্টে একজনকে দুর্বৃত্তরা গুলি করছে জানতে পেরে তাদের রক্ষা করতে ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা। এ সময় দুর্বৃত্তরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।’ হলি আর্টিসান বেকারির সুপারভাইজার সুমন রেজা জানান, পুলিশ যখন রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে, তখন সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে শতাধিক গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে তারা গ্রেনেড ছোড়ে। ওই সময় কয়েকজন পুলিশ আহত হন। গুলশানে জিম্মি হয়ে পড়াদের মধ্যে আনুমানিক ২০ জনই বিদেশি রয়েছেন। সুমন নিজে ও আর্টিসানের আরেকজন কর্মী (ইতালির নাগরিক) দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বাইরে আসতে সক্ষম হন। সুমন বলেন, ‘আমি ছাদে ছিলাম। ওরা যখন বোমা মারতে ছিল, তখন বিল্ডিং কাঁপতে ছিল। ওরা ১০-১২টা বোমা মারছে। মারতেই আছে, মারতেই আছে। ওরা সামনের দিকে স্টেপ নিচ্ছিল মনে হচ্ছিল। তখন ছাদ থেকে লাফ দিই। ভিতরে থাকা আমাদের কর্মীরা ফোন ধরতেছে না। আমাদের স্টাফদের মধ্যেও দুজন বিদেশি। আর্জেন্টাইন কর্মীর কোনো খোঁজ নেই।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসীরা প্রবেশের কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ-র‌্যাব হোটেলটি ঘিরে ফেলে। পুলিশের উপস্থিতি দেখা মাত্র তাদের উদ্দেশে গুলি ও গ্রেনেড ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। শুরু হয় ব্যাপক গোলাগুলি। এর মধ্যেই আহত হন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাধারণ মানুষ। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়। কিন্তু ভিতর থেকে থেমে থেমে চালানো হয় গুলি। দশটার পরে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ভিতর থেকে গ্রেনেড হামলা করা হয়। রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে ভিতর থেকে অস্ত্রধারীরা পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। পৌনে ১১টায় আবার গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এর মধ্যেই হোটেল গেটের পাশে থাকা বনানী থানার ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। রাত ২টা পর্যন্ত এ ঘটনায় ইউনাইটেড হাসপাতালে দুই পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম ও সালাউদ্দিন খান নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি অবস্থিত ইউনাইটেড হাসপাতালে নিহতদের মরদেহ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই হাসপাতালে আরও ১৫-২০ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ঢাকা মেডিকেলে কমপক্ষে দুই পুলিশ ও এক ড্রাইভার চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্যদিকে, গোলাগুলি শুরুর পরপরই ঘটনাস্থলসহ পুরো গুলশান, বনানী ও বারিধারার রাস্তা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। আশপাশের সব যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে টহল দেয় হেলিকপ্টার।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত র‌্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদ রাত সোয়া ১১টায় সাংবাদিকদের বলেন, সন্ধ্যার পর এ রেস্টুরেন্টে কয়েক দুর্বৃত্ত প্রবেশ করে। এরপর রেস্টুরেন্টের কয়েক কর্মচারী বের হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের। দুর্বৃত্তদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। আমরা তাদের সমস্যা শোনার চেষ্টা করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা রয়েছে। যাদের জিম্মি করা হয়েছে, তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। রাতে হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টের সামনে উদ্বিগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারতীয় নাগরিক সঞ্জীব সেন। তিনি জানান, তার মেয়ে হোটেলে আটকে পড়েছেন। এর পর থেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য হোটেলের টেলিফোন নম্বরে লাগাতার ফোন করছেন। কিন্তু ফোন রিং হলেও ওপাশ থেকে কেউ ধরছে না। আমি শুনতে পেয়েছি সেখানে ১৮-১৯ জন মানুষ আটকে পড়েছে। রেস্টুরেন্টে সপরিবারে খেতে আসা ইঞ্জিনিয়ার হাসনাত করিম রাত ১০টা ৪১ দিকে টেলিফোনে চাচা আনোয়ারুল করিমকে জানান, ‘র‌্যাব-পুলিশ যেন গুলি না করে। নইলে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে।’

ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদকরা জানান, রাত ১২টার পর থেকে বেকারি ও রেস্টুরেন্ট ভবনের সব বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে অন্ধকার করে দেয় সন্ত্রাসীরা। পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি সেখানে উপস্থিত হয় বোমা বিস্ফোরণ স্কোয়াড, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য। রাত দেড়টার দিকে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়। অভিযানের জন্য উপস্থিত হয় নৌবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো দল। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকিংয়ের মাধ্যমে জঙ্গিদের কাছ থেকে দাবি-দাওয়া জানতে চাওয়া হয়। সেই সঙ্গে জিম্মি নাগরিকদের কোনো ক্ষতি না করতে অনুরোধ জানানো হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘অভিযানের পুরো প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সর্বনিম্ন ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।’

এর আগে, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশে বিদেশিদের ওপর ‘নির্বিচারে হামলা’র আশঙ্কা করছিল পশ্চিমা নাগরিকরা। বিদেশিরা মিলিত হন এমন স্থানেই এ হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষ থেকে প্রথম এমন তথ্য পাওয়ার পর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছিল। সে সময় বিদেশিদের একসঙ্গে সমাবেশের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা। পরে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। চলতি বছরে এসে সেই সতর্কতা কমে এলেও গত মাসে নতুন করে সতর্কতা দিয়েছিল।

সতর্ক বিদেশিরা বন্ধ চলাচল : গুলশানে রেস্টুরেন্টে হামলার পর পর সতর্ক হয়ে উঠেছে পুরো বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশির ভাগ রাষ্ট্রের রাজধানী থেকে তাদের নাগরিকদের ঢাকায় চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ঢাকার দূতাবাসগুলোর পক্ষ থেকে গুলশান-২ এর হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনা জানিয়ে তাদের নাগরিকদের কাছে এসএমএস পাঠানো হয়। মিশনগুলোর পক্ষ থেকে জরুরি  যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বরও সরবরাহ করা হয় সামাজিক যোগাযোগ ও ই-মেইলসহ বিভিন্নভাবে। পরে ওয়াশিংটনসহ বিভিন্ন দেশের রাজধানী থেকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেও সতর্ক করা হয় নাগরিকদের। ভ্রমণ সতর্কতা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে। ঘটনার পর পরই মার্কিন দূতাবাসের বিশেষ বার্তায় বলা হয়, গুলশান-২-এ গোলাগুলি ও জিম্মির ঘটনা ঘটেছে। সবাই নিরাপদ স্থানে থাকুন ও টেলিভিশন নিউজে চোখ রাখুন। দূতাবাসের মুখপাত্র বলেছেন, ঘটনার পেছনে কারা রয়েছে তা এখনো জানা যায়নি। তারা কী উদ্দেশে এ ঘটনা ঘটিয়েছে সে তথ্যও এখনো জানা যায়নি। কানাডার পক্ষ থেকে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে বলা হয়, আশপাশের সবকিছুর বিষয়েই সতর্ক থাকুন। কোথাও একত্রিত হবেন না। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন। অনুরূপ বার্তা প্রচার করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, সুইডেন, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়ার পক্ষ থেকেও। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও ফ্রান্সের পক্ষ থেকে তাদের নাগরিক ভিতরে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। ভারতীয় এক কিশোরী থাকার কথা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন তার উদ্বিগ্ন বাবা।

সর্বশেষ খবর