শনিবার, ২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
হঠাৎ থমকে যায় গুলশান, রেস্তোরাঁয় দেশি-বিদেশিদের জিম্মি

রাতভর রুদ্ধশ্বাস ঘটনাপ্রবাহ

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাত সোয়া ৮টা : গুলশান-২ এর হলি আর্টিসান বেকারি নামে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁর সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। লেকভিউ ক্লিনিক ও নর্ডিক ক্লাবেও মানুষের চলাচল ছিল। রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে আসেন অন্তত ২০ জন বিদেশি নাগরিক। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকেও পরিবার নিয়ে খেতে আসেন কেউ কেউ। এ সময় ওই রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে ১৫ থেকে ২০ জন সশস্ত্র যুবক। যাদের সবার বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে।

রাত সাড়ে ৮টা :  ওই যুবকরা রেস্তোরাঁর সবাইকে জিম্মি ঘোষণা করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা ফাঁকা গুলি করে। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করে। তখন ভিতরে ২০ জনের মতো বিদেশি নাগরিক ছিলেন। বেকারির সুপারভাইজার সুমন রেজা ও আর্টিসানের আরেকজন কর্মী (ইতালির নাগরিক) দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বাইরে আসতে সক্ষম হন।

রাত পৌনে ৯টা : ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। পুলিশ ভিতরে প্রবেশ করতে অভিযান চালায়। ওই সময় ভীতি প্রদর্শনের জন্য পুলিশ কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় ভিতর থেকে সন্ত্রাসীরা পাল্টা গুলি ছোড়ে। দুই পক্ষই গোলাগুলির পাশাপাশি ভিতর থেকে অন্তত ১০-১২টা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা।

রাত ৯টা : ঘটনাস্থলে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, বিজিবি ও সোয়াতের সদস্যরা যোগ দেন। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও ভিড় জমায়। গণমাধ্যমের কর্মীরাও চলে আসেন ঘটনাস্থলে। এ সময় গুলশান, বনানীসহ আশপাশের সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পুরো ওই এলাকার বসবাসকারীরা।

সাড়ে ৯টা : পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াত ও বিজিবির নেতৃত্বে যৌথবাহিনী ওই রেস্টুরেন্টে দ্বিতীয় দফায় অভিযান চালায়। ঘটনাস্থলে থাকা র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ঘটনাস্থলের সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেখানে কিছু অস্ত্রধারী প্রবেশ করেছে। সেই রেস্তোরাঁর কিছু কর্মচারী বের হয়ে এসেছে। তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এখন আমরা চেষ্টা করছি, যাতে শান্তিপূর্ণভাবে এটা কিছু করা যায়। এটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। কারণ, প্রতিটি জীবন আমাদের কাছে মূল্যবান।’

রাত ১০টা ৩৫ মিনিট : ভিতর থেকে অস্ত্রধারীরা পরপর দুটি  বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়।

রাত পৌনে ১১টা : ভিতর থেকে আবার গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এ সময় বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন খানসহ আহত কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়।

রাত ১২টা : সালাউদ্দিন খানকে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত ঘোষণা করে। তার মরদেহ গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাখা হয়। সেখানে উপস্থিত থাকা তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. মোস্তফা এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

১২টা ২৩ মিনিট : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখান থেকেই তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।

রাত সাড়ে ১২টা :  র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির শক্তি বাড়ানো হয়। বড় ধরনের অপারেশনের প্রস্তুতি নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে যৌথবাহিনী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করে। এ সময় ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্স, রায়টকারসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় যৌথবাহিনী।

রাত সোয়া ১টা : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামকে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত ঘোষণা করে। এর আগে দ্বিতীয় দফা অভিযানে গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে আহত হন রবিউল।

রাত দেড়টা : রাত দেড়টায় জিম্মিদের সঙ্গে কথা বলতে মাইকিং করা হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত জিম্মিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসার চেষ্টা চালানো হয়।

রাত ১টা ৫০ : নৌবাহিনীর কমান্ডো টিম গুলশানে ঘটনাস্থলে আসে। এ টিমে ছিল অন্তত ৩০ জন। তারা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করে।

হঠাৎ থমকে যায় গুলশান : ঈদের আগে শেষ শুক্রবার তথা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গুলশান এলাকাজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা সারতে অভিজাত এ এলাকার বিভিন্ন শপিং মল ও বুটিক হাউসে ভিড় জমিয়েছিল নানা বয়সী ক্রেতা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই ছিল উচ্চবিত্ত শ্রেণির। ক্রেতাসমাগমের কারণে এদিন গুলশানে ছিল প্রাইভেট কারের দীর্ঘ সারি। বিশেষ করে গুলশান আড়ং, শপার্স ওয়ার্ল্ড, পিংক সিটি মার্কেটসহ বড় বড় কয়েকটি শপিং মলে ক্রেতা উপস্থিতি ছিল চোখের পড়ার মতো। কিন্তু রাত সাড়ে ৮টার দিকে গোটা এলাকার দৃশ্যপট বদলে যায়। গুলশানে অবস্থিত হলি আর্টিসান হোটেলে সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলায় গুলশান ও আশপাশ এলাকার দৃশ্যপট মুহূর্তেই বদলে যায়। এ হোটেলের মধ্যে অবস্থিতদের আটকে রাখে সন্ত্রাসীরা। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যাতে ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে এজন্য সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি করলে ও গ্রেনেড ছুড়লে ভয়ঙ্কর শব্দে গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ হোটেলটির আশপাশে অবস্থিত বাসিন্দারাও এ ঘটনায় ভীত হয়ে পড়েন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গুলশানের আশপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে গোটা এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়। রাতে দীর্ঘ সময় ধরে গুলশানের সড়কে প্রাইভেট গাড়িগুলোকে এক জায়গায় আটকে থাকতে দেখা যায়।

সর্বশেষ খবর