রবিবার, ৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

রুদ্ধশ্বাস ১৫ ঘণ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রুদ্ধশ্বাস ১৫ ঘণ্টা

রেস্টুরেন্টের বারান্দায় জিম্মি এক বিদেশির পেছনে দুই জঙ্গি। ছবিটি গতকাল সকালে তোলা

রাত সোয়া ৮টা : গুলশান-২-এর হলি আর্টিসান বেকারি নামে স্প্যানিশ রেস্তোরাঁর সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। লেকভিউ ক্লিনিক ও নর্ডিক ক্লাবেও মানুষের চলাচল ছিল অন্যদিনের মতোই। রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে আসেন অন্তত ২০ জন বিদেশি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকেও পরিবার নিয়ে অনেকে খেতে আসে সেখানে। এ সময় ওই রেস্তোয়াঁর প্রবেশ করেন ৮-১০ জন যুবক, যাদের বয়স ২০-৩০-এর মধ্যে।

৮টা ৩০ : ওই যুবকরা রেস্তোরাঁর সবাইকে জিম্মি ঘোষণা করে। এ সময় সন্ত্রাসীরা ফাঁকা গুলি করে। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করে। বেকারির সুপারভাইজার সুমন রেজা ও আর্টিসানের আরেকজন কর্মী (ইতালির নাগরিক) দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে বাইরে আসতে সক্ষম হন।

পৌনে ৯টা : ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। গণমাধ্যমে বিদেশি জিম্মি ঘটনা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এরপর পুলিশ প্রথম দফায় ভিতরে প্রবেশ করতে অভিযান চালায়। ভীতি প্রদর্শনের জন্য কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছোড়ে। এ সময় ভিতর থেকে সন্ত্রাসীরা পাল্টা গুলি ছোড়ে। দুই পক্ষই গোলাগুলির পাশাপাশি ভিতর থেকে অন্তত ১০-১২টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় সন্ত্রাসীরা।

৯টা ৫০ : প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনসহ আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। আশপাশ এলাকায় যান চলাচল সীমিত করা হয়। নগরজুড়েই সতর্ক অবস্থানে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

৯টা : ঘটনাস্থলে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, বিজিবি ও সোয়াতের সদস্যরা যোগ দেন। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও ভিড় জমান। গণমাধ্যমের কর্মীরাও চলে আসেন ঘটনাস্থলে। এ সময় গুলশান, বনানীসহ আশপাশের সব সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

৯টা ৩০ : পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াত ও বিজিবির নেতৃত্বে যৌথ বাহিনী ওই রেস্টুরেন্টে দ্বিতীয় দফায় অভিযান চালায়। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেখানে কিছু অস্ত্রধারী প্রবেশ করেছে। সেই রেস্তোরাঁর কিছু কর্মচারী বের হয়ে এসেছে। তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এখন চেষ্টা করছি যাতে শান্তিপূর্ণভাবে কিছু করা যায়। এটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। কারণ, প্রতিটি জীবন আমাদের কাছে মূল্যবান।’

১০টা : হেলিকপ্টারে গুলশানে টহল দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আকাশ থেকে শক্তিশালী ক্যামেরায় ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে তারা।

১০টা ৩৫ : ভিতর থেকে অস্ত্রধারীরা পরপর দুটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এ সময় চারদিকে ঘিরে থাকা র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যান।

১০টা ৪৫ : ভিতর থেকে আবার গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এ সময় বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন খানসহ আহত কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়।

১২টা : সালাউদ্দিন খানকে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত ঘোষণা করে। তার লাশ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাখা হয়।

১২টা ২৩ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখান থেকেই তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।

১২টা ৩০ : র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির শক্তি বাড়ানো হয়। বড় ধরনের অপারেশনের প্রস্তুতি নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে যৌথ বাহিনী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করে। এ সময় ঘটনাস্থলে অ্যাম্বুলেন্স, রায়টকারসহ বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় যৌথ বাহিনী।

১টা ১৫ : ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামকে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত ঘোষণা করে। এর আগে দ্বিতীয় দফা অভিযানে গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে আহত হন রবিউল ইসলাম।

১টা ৩০ : সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কথা বলতে মাইকিং করা হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসার চেষ্টা চালানো হয়।

১টা ৫০ : নৌবাহিনীর কমান্ডো টিম গুলশানে ঘটনাস্থলে আসে। এ টিমে ছিলেন অন্তত ৩০ জন। তারা অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করে।

৩টা : সন্ত্রাসীদের জিম্মিদশা থেকে দুজনকে জীবিত উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের একজন হলেন স্প্যানিশ নাগরিক দিয়েগো স্তেন। তিনি রেস্তোরাঁটিতে বাবুর্চি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অন্যজন বাংলাদেশি নাগরিক বেলাল। তিনিও রেস্তোরাঁর কর্মচারী।

৩টা ৪৫ : পুলিশ ১৮-২০ বছর বয়সী এক তরুণকে রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করে নিয়ে যায়। ওই তরুণ নিজের পরিচয়, সেখানে অবস্থানের কারণ বা কীভাবে রক্তাক্ত হয়েছেন, সেসব বিষয়ে সন্তোষজনক কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য।

৪টা : প্রস্তুতির মধ্যেই অভিযানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পুলিশপ্রধান এ কে এম শহীদুল হক, র‌্যাবপ্রধান বেনজীর আহমেদসহ বিভিন্ন বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়।

৪টা ২০ : ইতালির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, ঢাকার রেস্তোরাঁয় বন্দুকধারীদের হাতে জিম্মিদের মধ্যে ইতালির সাতজন নাগরিক আছেন। ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানায়, ঘটনাস্থল থেকে একজন ইতালীয় জিম্মি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। দেশটির গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, পালিয়ে আসা ইতালীয় পুলিশকে জানিয়েছেন, ভিতরে আরও সাতজন ইতালীয় আটকে আছেন।

ভোর ৫টা : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথ বাহিনী অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি নেয়। যৌথ বাহিনীতে ছিল সেনাবাহিনী, পুলিশ, র?্যাব, বিজিবি, নৌবাহিনীর কমান্ডো এবং বিশেষ বাহিনী সোয়াত। হ্যান্ডমাইকে সাধারণ পোশাকের সবাইকে সেখান থেকে সরে যেতে বলা হয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা সাদা পোশাকে সেখানে আছেন, তাদের সবাইকে বাহিনীর ব্যাজ পরতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

সকাল ৭টা ৩০ : রাতভর গুলশানের হোলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টসংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর সেনা, নৌ, পুলিশ, র?্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়।

৭টা ৪৫ : কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দলের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের ভিতর প্রবেশ করেন। অভিযান চলাকালে মুহুর্মুহু গুলি-বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে গুলশান। ঘটনাস্থল থেকে একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্যারা কমান্ডোদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানকে অংশ নিতে দেখা যায়।

৮টা ১৫ : সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান হলি বেকারির দেয়াল ভেঙে ভিতরে ঢোকে। ওই কম্পাউন্ডের বাইরের দিকে থাকা পিজা কর্নার এ সময় গুঁড়িয়ে যায়। লেকভিউ ক্লিনিকের পার্কিংয়ে রাখা দুটি গাড়ি দুমড়ে যায়। রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী, শিশুসহ ছয়জনকে উদ্ধার করা হয়। একজনকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয়।

৮টা ৩০ : অভিযানের শেষ দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার নিয়ে ওই ভবনের দিকে যান। কিছু সময় পর একদল চিকিৎসকও স্ট্রেচার নিয়ে ওই ক্যাফের ভিতরে যান। কমান্ডো অভিযানে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন কয়েকজন।

৮টা ৫৫ : ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেন অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভিতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করেন গোয়েন্দারা।

৯টা ১৫ : অভিযান শেষ ঘোষণা করা হয়। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুলশানের রেস্টুরেন্টে প্রায় ১৫ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়। রাতেই ২০ জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে বলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়।

১০টা : চার বিদেশিসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়। রেস্টুরেন্টের ভিতরে অজ্ঞাত পাঁচজনের মৃতদেহ পাওয়ার কথা পুলিশ জানায়।

১১টা ৪৫ : বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনাকে জঙ্গি হামলা আখ্যায়িত করে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ছয় জঙ্গি গুলিতে নিহত হয়েছেন। একজন আটক।

১টা ৩০ : সংবাদ সম্মেলন করে অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর—আইএসপিআর। এতে জানানো হয় : ২০ বিদেশি জিম্মিকে রাতেই হত্যা করা হয় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। তিন বিদেশিসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। হামলাকারীরা মারা যাওয়ার পর একটি একে-২২ রাইফেল, চারটি পিস্তল, চারটি অবিস্ফোরিত আইইডি উদ্ধার করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর