রবিবার, ৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

এই দুঃখ সইব কী করে, রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ

নঈম নিজাম

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে লিখছি। আলো থেকে অন্ধকারে প্রবেশ করছি আমরা। এই বাংলাদেশ আমরা দেখতে চাইনি। এই বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেননি আমার ভাই। নিন্দা জানানোর ভাষা নেই গুলশানের বর্বরোচিত হামলার। ধর্মের নামে এ কোন নৃশংসতা? ব্যক্তিগত জীবনে আমি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। নিজের অর্থ ব্যয়ে মসজিদ নির্মাণ করেছি। রোজা রাখি নিয়মিত। ছোটবেলায় ঘুম ভাঙত মায়ের কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত শুনে। বাবার তাগাদায় মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করতাম। বাবার বড় ভাই ছিলেন মৌলভি। মেধাবী আলেম হিসেবে খ্যাতি ছিল তার। তিনি শুক্রবার ও ঈদের নামাজের সময় চড়া গলায় বয়ান করতেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। প্রতিটি মুসলমানকে শান্তির পথে থাকতে হবে। কোনো বাড়াবাড়িই আল্লাহপাক বরদাশত করেন না।’ বাবার আরেক চাচাতো ভাই মাওলানা ছিলেন। একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। তার দুই ছেলেও মাওলানা, মুফতি। তারা এখন ঢাকার দুটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন। গতকাল কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তাদের প্রশ্ন করি এটা কোন ইসলাম? মুসলমানরা যখন তারাবির নামাজ নিয়ে ব্যস্ত তখন নিরীহ মানুষ হত্যা আর রক্তের উৎসবের কথা ইসলামের কোথায় আছে? ধর্মপ্রাণ আলেমরা আমাকে বললেন, ‘ইসলামে কোনো জঙ্গিবাদ আর ধর্মের নামে মানুষ হত্যার কথা নেই। ইসলাম এই বর্বরতা সমর্থন করে না।’ ইসলামের নামে এই খুনোখুনি ভয়ঙ্কর মানসিক রোগীদের কাজ। এই নৃশংসতা বন্ধ না হলে সারা দুনিয়ার মুসলমানরা সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশের নামে ভুল বার্তা যাবে সারা দুনিয়ায়। গুলশানের আক্রমণের খবর সিএনএন সারা রাত লাইভ সম্প্রচার করেছে। বিবিসি, আলজাজিরাসহ বিদেশি গণমাধ্যম ছিল ২৪ ঘণ্টা বাংলাদেশ নিয়ে। এভাবে প্রচার হলে দুনিয়ার মানুষ মুসলমানদের আর বিশ্বাস করবে না। বাংলাদেশকে দেখবে অন্য চোখে। জঙ্গিদের হামলার দিনটি ছিল শুক্রবার। শুক্রবার জুমাবার, মুসলমানদের কাছে পবিত্র একটি দিন। সন্ধ্যায় ইফতার সেরে বিমানবন্দর গিয়েছিলাম বিদেশগামী ছেলেকে বিদায় জানাতে। ছেলে ফিরে যাচ্ছে ছুটি কাটিয়ে। বিমানবন্দর থেকে রাত সাড়ে ৯টায় অফিসে ফিরলাম। তার কিছুক্ষণ পরই শুনি গুলশানে গোলাগুলি হচ্ছে। গুলশানে আমার একটি কাজ ছিল। অফিসের প্রশাসন বিভাগের দুই সহকর্মীকে নিয়ে বের হলাম। কিন্তু ফিরে এলাম পথ থেকে। গোলাগুলিকে প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম কোনো সাধারণ সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের কাজ। ঈদ সামনে রেখে অপকর্ম করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মূল ঘটনা শুনলাম। রাতভর অফিসে কাটালাম গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে। শুধু আমি নই, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে রাতটি পার করেছে। রাতে অফিসে বসে পত্রিকার নতুন সংস্করণ বের করছি। টিভির সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের বার বার সতর্ক করেছি সংবাদ পরিবেশনে সতর্ক থাকতে। কারণ বাংলাদেশ গভীর সংকটে। এই সংকট আমার চিরচেনা ঐতিহ্যের পরিপন্থী। অসাম্প্রদায়িক চিন্তার পরিপন্থী। একজন সুন্নি মুসলমান হিসেবে ইতিবাচক চিন্তার পরিপন্থী। এ দেশের মানুষ কোনো বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। তারা উগ্রবাদ যেমন অপছন্দ করে তেমনি ধর্মবিরোধীদেরও। দেশের এই ঐতিহ্য আজ হুমকি ও চ্যালেঞ্জের মুখে। তাই জাতির কঠিনতম সময়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে সবাইকে। দৃঢ় অবস্থান থেকে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে সাহস আর তেজস্বিতার সঙ্গে। দেশের মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখবে দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে, যারা শুক্রবার রাতে জীবন বিলিয়ে দিলেন দেশের নিরাপত্তার জন্য। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কমান্ডো, বর্ডার গার্ড, র‌্যাব, পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সাহসিকতা খুবই প্রশংসনীয়। তারা দৃঢ় মনোভাব নিয়ে সবকিছু সামাল দিয়েছে। জাতির এই কঠিন সময়ে দেশের সব নাগরিককে একসঙ্গে একমতে থাকতে হবে। দেশের অর্জিত সুনাম আমাদের ধরে রাখতে হবে। এই দেশকে আমরা পাকিস্তান বানাতে দিতে পারি না। কারণ বিশ্বজুড়ে আজ বাংলাদেশের নাগরিকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এতদিন যে দুর্নাম বাংলাদেশের ছিল না তা যুক্ত করতে দেওয়া যাবে না। কারণ এতে আমাদের প্রবাসীরা প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ। বিদেশিরা এ দেশে আসতে চাইবে না। বাংলাদেশ ধ্বংসের আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গুলশানের নৃশংসতার আবারও নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জঙ্গিদের হাতে নিহত সবার পরিবারের প্রতি জানাই গভীর শোক ও সমবেদনা। জানি আজ কোনো সমবেদনা এই পরিবারগুলোর চোখের অশ্রু মুছে দিতে পারবে না। তবুও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা : সবাইকে শোক সইবার তৌফিক দিন। আর শক্তি ও সাহস দিন গোটা দেশের মানুষ যাতে সবকিছু সামাল দিতে পারে।

সর্বশেষ খবর