রবিবার, ৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

আল কোরআন

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

হিজরিপূর্ব ১৩ সনের ২৭ রমজান (৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই, সোমবার) শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে প্রত্যাদেশ (ওহি) প্রেরিত হয় : ‘পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন — সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পাঠ কর। আর তোমার প্রতিপালক মহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন — শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না।’ (সূরা আলাক, আয়াত ১-৫)। এটিই আল কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ ওহি এবং এতে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, কলমের সাহায্যে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ আল কোরআনের মাধ্যমে মানব জাতির প্রতি আল্লাহ রব্বুল আলামিনের প্রথম ও প্রধান নির্দেশ। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মানব জাতির ঐতিহাসিক মুক্তির এই নির্দেশনা এসেছে মাহে রমজানে। এই নির্দেশনা অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার এবং অজ্ঞানতার বেড়াজাল পার হওয়ার অনুপ্রেরণা।

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত— সৃষ্টির সেরা জীব। এই মানুষকে শিক্ষার মাধ্যমেই ফেরেস্তাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : ‘তিনি (আল্লাহ) আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর এই বস্তুগুলো ফেরেস্তাদের সামনে উপস্থিত করলেন এবং বললেন, ওইসবের নাম আমাকে বলে দাও যদি তোমরা সত্য অবগত হও।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ৩১)। ফেরেস্তারা নাম বলতে পারেনি, প্রথম মানব আদম (আ.) পেরেছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো এবং সে কারণে আল্লাহর আদেশে আদম (আ.)-কে ফেরেস্তারা সিজদা করেছিল।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে শিক্ষাই হলো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের অন্যতম উপায়। অর্থনৈতিক সম্পদ, সামরিক শক্তি, ভৌগোলিক বিরাটত্ব কিংবা বিশাল জনবল— কোনো কিছুই চূড়ান্ত শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের মানদণ্ড নয়। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে জাতি যত অগ্রসর সে জাতির আধিপত্য ও স্থায়িত্ব তত বেশি নিশ্চিত।

জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত একজন ব্যক্তির কাছে তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ; তার ভালোমন্দ, আনন্দ-সর্বনাশ— সবই অত্যন্ত পরিষ্কার। তাকে কেউ সহজে বিভ্রান্ত করতে পারে না। মানব ইতিহাসে অত্যাচার-নির্যাতন, শোষণ-বঞ্চনার ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অজ্ঞ-অশিক্ষিত সম্প্রদায়কেই সব ক্ষেত্রে অনির্বচনীয় ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে।

একজন শিক্ষিত ব্যক্তি তার নিজের জন্য যেমন কল্যাণকর তেমন সমাজের জন্য, দেশের জন্য কল্যাণকর। প্রকারান্তরে একজন অজ্ঞ-অশিক্ষিত ব্যক্তি নিজের জন্য তো বটেই দেশের জন্যও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তার বড় আফসোস, দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে, অগ্রগতি ও প্রতিযোগিতার সমাজে সে স্বচ্ছন্দে অভিযাত্রী হতে পারে না। সমাজের শিক্ষিতরা তাকে আলোর পথে আনার নৈতিক দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী হলেও তাকে শোষণের সহজাত দুরভিসন্ধি ত্যাগ করতে পারে না। একজন অজ্ঞ-অশিক্ষিত ব্যক্তিকে নানান ছলছুতায় ঠকানো ও বিভ্রান্ত করা যেমন সহজ তেমন একটি অশিক্ষিত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পশ্চাত্পদ জাতিকে নানানভাবে সমস্যার জালে জড়িয়ে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে এর সব উন্নতির পথ অবরুদ্ধ করাও সহজ।

ব্যক্তি থেকে সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র। দেশে প্রকৃত কল্যাণ ও উন্নতির পূর্বশর্ত হলো ব্যক্তির উন্নতি। ব্যক্তির সশিক্ষিত হওয়ার অবকাশ সৃষ্টি না হলে, ব্যক্তি প্রকৃত প্রস্তাবে নিজের ও দেশের জন্য কল্যাণকর পর্যায়ে উন্নীত না হলে দেশের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে না। এটিই বাস্তব সত্য। সুতরাং ব্যক্তি তথা সমাজের প্রকৃত কল্যাণ সাধনে সবার আগে তাকে শিক্ষা ও জ্ঞানে বলীয়ান হতে হবে এবং তখনই অন্যসব সমস্যা সমাধান সহজতর হবে। শিক্ষিত জনশক্তিই জাতীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অন্যতম অবলম্বন।

নিরক্ষরকে অক্ষর দান, জ্ঞানহীনকে জ্ঞানের পথে নিয়ে আসা এবং সবাই মিলে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় চেষ্টিত হওয়ার তাগিদ আজ আমাদের সামনে উপস্থিত। মাহে রমজানে আল্লাহ রব্বুল আমামিন আল কোরআনে যে মহান নির্দেশ মানব জাতির জন্য দিয়েছেন তা উপলব্ধির মধ্যে সিয়াম সাধনার যথার্থ সার্থকতা রয়েছে। সিয়াম সাধনা শুধু পরিপালনীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, তা সার্বিক জাগৃতির অনুপ্রেরণাও বটে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর