মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

গুলশান হামলার নির্দেশদাতা কে

মির্জা মেহেদী তমাল

গুলশান হামলার নির্দেশদাতা কে

গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া জঙ্গিরা সাত মাস ধরে কোথায় ছিল? কারা তাদের আশ্রয় দিয়েছিল? কারা তাদের অস্ত্র জোগানদাতা? নির্দেশদাতা কে? কোথায় নিয়েছিল প্রশিক্ষণ— সেসব প্রশ্ন এখন উঠে আসছে। সন্তান নিখোঁজ হওয়ার পর বাবা-মা থানা-পুলিশ ও মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন তখন সেই নিখোঁজ সূত্র ধরে তদন্ত করলে এই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটত না।

সূত্রগুলোর মতে, জঙ্গি অর্থায়নকারীদের এখনো সঠিকভাবে শনাক্ত করা যায়নি। তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। এমনকি গুলশানের নারকীয় ঘটনার পর পুলিশ যেসব নাম পাঠিয়েছিল, বাস্তবে জঙ্গিদের নাম তা ছিল না। তাই অনেকে মনে করেন এখনো সঠিকভাবে তদন্ত না করলে আগামী দিনে গুলশান ঘটনার চেয়ে আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স ঢাকায় আরও হামলার আশঙ্কা করে খবর দিয়েছে। নিহত জঙ্গিদের বিষয়ে তদন্ত করে দেখা গেছে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টার দিকে মীর সামি মোবাশ্বির কোচিং সেন্টারে যাওয়ার জন্য গাড়িতে করে বাসা থেকে বের হয়। যানজট থাকায় কোচিং সেন্টারের আগেই গাড়ি থেকে নেমে যায়। পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে গাড়িচালক জুয়েল তাকে কোচিং থেকে আনতে গেলে তাকে আর পাওয়া যায়নি। পরে মোবাশ্বিরের বাবা মীর এ হায়াত কবীর ওই দিনই গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর ১৮৪৮) করেন। পুলিশ তার খোঁজ করতে গিয়ে গুলশান এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পায়, মোবাশ্বির গাড়ি থেকে নামার পর একটি রিকশা নিয়ে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের দিকে চলে যাচ্ছে। সামি স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে ও লেভেল পাস করেছে। এ লেভেল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাবা মীর এ হায়াত কবীর একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরি করেন। মা একটি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থানা পুলিশ, র‌্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে তারা গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো হদিস পাননি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও কোনো সহযোগিতা করতে পারেনি। হামলাকারীদের আরেকজন নিবরাস ইসলাম। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। সাবেক সহপাঠীরা শনাক্ত করে তার ছবি ও পরিচয় সামনে নিয়ে আসে। মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র ছিলেন নিবরাস ইসলাম। ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে নিবরাস বড়। বাসা ঢাকার উত্তরায়। তার নিকটাত্মীয়রা সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে চাকরি করেন। বলা হচ্ছে, নিবরাস যে মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় এসেছিলেন, তা-ই জানত না পরিবার। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উপমহাসচিব ও সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে রোহান ইমতিয়াজ। ফেসবুক দেখে বোঝা যায়, তিনি কিছুদিন ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি ফেসবুকে ছেলের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘প্লিজ কাম ব্যাক’। রোহানের মা শিক্ষিকা। দুই ভাইবোনের মধ্যে রোহান বড়। সে ঢাকার স্কলাসটিকা থেকে এ লেভেল শেষ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে রোহান নিখোঁজ। রোহান নিখোঁজ হয়েছে জানিয়ে গত ৪ জানুয়ারি থানায় জিডি করা হয়েছিল। জিডিতে বলা হয়, ৩০ ডিসেম্বর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে রোহান আর বাসায় ফেরেনি। পরে তদন্তে দেখা যায়, রোহান জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্ত। এরপর তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলে, যাতে দেশের বাইরে যেতে না পারে, সে জন্য বিমানবন্দরেও জানানো হয়েছিল। ছয়-সাত মাস ধরে উত্তরবঙ্গের অন্তত তিনটি হত্যাকাণ্ডে খায়রুল ইসলামের নাম এসেছে। তাকে তখন থেকেই খোঁজা হচ্ছিল। সম্ভবত খায়রুল গুলশানে হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিল। বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চুতিনগর ইউনিয়নের ব্রিকুষ্টিয়া গ্রামের দিনমজুর আবু হোসেনের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে খায়রুল বড়। ব্রিকুষ্টিয়া দারুল হাদিস সালাদিয়া কওমি মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়েছিল খায়রুল। এরপর ডিহিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসা থেকে সে দাখিল পাস করে। গণমাধ্যমে ছবি দেখেই বাবা-মা ও প্রতিবেশীরা খায়রুলকে চিনতে পারেন। গ্রামে জানাজানি হয়। পুলিশ একটি ছবি নিয়ে বাড়িতে যায়। তার বাবা-মা প্রথমে ছবিটি চিনতে পারছেন না বলে পুলিশকে জানান। পরে পুলিশ কর্মকর্তারা খায়রুলের ছবি দেখতে চাইলে বিষয়টি বেরিয়ে আসে। পুলিশ খায়রুলের মা-বাবাকে আটক করেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মুহূর্তে বেশি জরুরি— কারা এই জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা, তাদের খুঁজে বের করা। গত ছয়-সাত মাসের একটা বড় সময় তারা ঢাকায় অবস্থান করছিল বলে মনে করা হচ্ছে। ঢাকার কোন এলাকায় কারা তাদের আশ্রয় দিয়েছিল, তাও বের করতে হবে। তদন্তের ক্ষেত্রে রাজনীতিমুক্ত না থাকলে নির্দেশদাতাদের বের করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে এত বড় ঘটনার বিষয়ে আগাম বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। গুলশান আক্রমণে নেপথ্য নায়কদের বের করতে হলে শুরু থেকে তদন্তের ধরন বদলাতে হবে। কারণ ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ও নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা। অতীতে যেভাবে মাদ্রাসা ও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের বিরুদ্ধে তদন্ত হতো—সেই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে মূল তদন্ত হোঁচট খাবে। বের হবে না, কারা এদের আশ্রয়দাতা, নির্দেশদাতা এবং অস্ত্র সরবরাহকারী। অজানা থেকে যাবে অর্থদাতাদের নামও। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও নজরদারিতে আনতে হবে। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ১ জুলাই রাতের জঙ্গিরা শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড ও রাইফেল ব্যবহার করে। তাদের অস্ত্রগুলো প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে ধারণা করা হচ্ছে, তারা উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাদের ওই অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছে কোনো শক্তিশালী গ্রুপ। দেশি জঙ্গিদের এমন যোগাযোগ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি ঘটনাস্থলের ছবি দিয়ে অনলাইনে প্রচার চালানোর বিষয়টিও আমলে নিয়েছে গোয়েন্দারা। ওই কর্মকর্তা বলেন, নিহত হামলাকারী, সন্দেহভাজন আটক ব্যক্তি এবং পরিকল্পনাকারীর পরিচয় শনাক্ত করে তাদের যোগাযোগের সূত্র খুঁজছে পুলিশ। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই জঙ্গি হামলার ঘটনার তদন্ত নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে পুলিশ সদর দফতর।

সর্বশেষ খবর