মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
রক্তাক্ত গুলশান । অশ্রুসিক্ত গুলশান

অশ্রু জলে শেষ শ্রদ্ধা

নিজস্ব প্রতিবেদক

অশ্রু জলে শেষ শ্রদ্ধা

রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে গতকাল গুলশান হামলায় নিহতদের শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (ওপরে), লাশ কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন শোকাহত স্বজন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

চোখের জল আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কান্নায় গুলশানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় নিহতদের স্মরণ করল বাংলাদেশ। রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামের স্মরণ অনুষ্ঠানে যখন হাজারো মানুষ শোক ও অশ্রুসজল নয়নে নিহতদের শ্রদ্ধা জানান তখন আষাঢ়ের আকাশও যেন শোকার্ত বাংলাদেশের সঙ্গী হয়েছিল। গতকাল দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের শেষ দিনে শোকে মুহ্যমান বাংলাদেশ জঙ্গি নৃশংসতার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ধিক্কারের পাশাপাশি নিহতদের কফিনে ফুল দিয়ে ভালোবাসা জানায়। সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিহতদের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে চোখের পানি মুছতে দেখা গেছে। কেঁদেছেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা দেশি-বিদেশিদের স্বজনরাও। স্টেডিয়ামে একটি মঞ্চের ওপর এ সময় নিহত তিন    বাংলাদেশি ইশরাত আখন্দ, অবিন্তা কবির ও ফারাজ হোসেনের কফিন রাখা হয়। এ সময় মঞ্চের ওপর বাংলাদেশসহ যে পাঁচটি দেশের নাগরিক নিহত হয়েছেন সেসব দেশের পতাকা টানানো ছিল। তিন বাংলাদেশির মধ্যে ইশরাত আখন্দ এবং ফারাজ হোসেনের কফিন বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে ঢাকা ছিল। দ্বৈত নাগরিক হওয়ায় অবিন্তা কবিরের কফিনে ছিল বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। ১৭ বিদেশির মরদেহ রাখা ছিল সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। সেখান থেকেই তাদের স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। গত শুক্রবার গুলশানে স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টে অস্ত্রধারী জঙ্গিরা ৯ ইতালীয়, ৭ জাপানি, দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৫ বাংলাদেশি ও একজন ভারতীয় নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরে যৌথবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় ৫ সন্ত্রাসী। সকাল ১০টায় ভুটানে সফরে থাকা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে প্রথমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বঙ্গভবনে দায়িত্বরত কমান্ডার মিনহাজ উদ্দিন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং তিনি কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এর আগে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে প্রধানমন্ত্রী নিহতদের স্বজন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলেন। স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী আবারও নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের সান্ত্বনা দেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা সবার মুখে একটাই প্রত্যয় ছিল সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই অব্যাহত রাখা। এ সময় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকসহ নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানগণ, পুলিশ মহাপরিদর্শক; বিজিবি ও র‌্যাবের মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর একে একে ইতালির রাষ্ট্রদূত ম্যারিও পালমা, জাপানের রাষ্ট্রদূত হরিগুচি, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট একের পর এক পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। নিহত বাংলাদেশি নাগরিকদের স্বজনরা ও হামলায় জীবন দেওয়া পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গ শ্রদ্ধা জানান। আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জানানোর পর নিহত বাংলাদেশি স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। সেনাবাহিনীর একজন সদস্য এ সময় পরিবারের সদস্যদের হাতে ডেথ সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। শ্রদ্ধা জানান, বিজনেস কমিউনিটির পক্ষে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, তৌফিক-ই-ইলাহী, ড. গওহর রিজভী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সাহারা খাতুন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, আওয়ামী লীগের নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আবদুস সোবহান গোলাপ, মৃণাল কান্তি দাস, এস এম কামাল হোসেন, ১৪ দলের নেতাদের মধ্যে শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মঈন উদ্দিন খান বাদল, শেখ শহীদুল ইসলাম, শিরিন আক্তার, ডা. শাহাদাৎ হোসেন, ওয়াজেদুল ইসলাম খান প্রমুখ। যুবলীগের মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী, হারুনুর রশিদ, কৃষক লীগের মোতাহার হোসেন মোল্লা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের পঙ্কজ দেবনাথ, ছাত্রলীগের সাইফুর রহমান সোহাগ প্রমুখ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে বিএনপির পক্ষ থেকে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এরপর মঞ্চটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় কমিটি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজম্ম লীগ, মত্স্যজীবী লীগ, হকার্স লীগ, তাঁতী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, জাতীয় বিদ্যুৎ শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু আইন পরিষদসহ বিভিন্ন দল, বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

সম্পর্কের ক্ষতি হবে না : ইতালির রাষ্ট্রদূত : ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা বলেন, ইতালীয় নাগরিক নিহতের ঘটনায় বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য সব দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে এই হামলার ঘটনায় আমরা শোকাহত। এই সংকট মোকাবিলায় ইতালি সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা আশা করি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আমরা পরস্পর সহযোগিতার কথা বলেছি। এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। বাংলাদেশের তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশি উদ্যমী তরুণদের অনুরোধ তোমরা উগ্রবাদীদের ফাঁদে পা দিও না। উগ্রবাদ-মৌলবাদ-সন্ত্রাসের পথে পা বাড়াবে না।

জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত : বার্নিকাট : যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট বলেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সব রকম সহায়তা দিতে প্রস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায়। গুলশানের ঘটনায় তিনি বলেন, এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত। আমরা বাংলাদেশকে সব রকম সহযোগিতা দিতে রাজি আছি। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

পাশে আছি : হর্ষবর্ধন শ্রিংলা : ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবেশী, বন্ধু এবং উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের সব সংকটে ভারত পাশে থাকবে। সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আমরা একসঙ্গে কাজ করব। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ ঘটনায় ফোন করে পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। জিম্মি ঘটনায় সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করেন ভারতের হাইকমিশনার।

ওদের আমরা নির্মূল করবই : গওহর রিজভী : শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি। জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে বলেই যে আমরা সেই নীতি থেকে ফিরে আসব এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। সরকার শক্ত হাতে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করবে। যে কোনো মূল্যে ওদের নির্মূল করবই।

আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐক্য চায় না : মির্জা ফখরুল : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে জাতীয় ঐক্য চায় না বলেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শর্ত দেওয়া হচ্ছে। আমরা সব সময়ই বলে আসছি, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য দরকার। কিন্তু সরকারের পক্ষে সাড়া নেই। তিনি বলেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর