মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

জঙ্গি অর্থায়নে জিরো টলারেন্সে সরকার

রুহুল আমিন রাসেল

জঙ্গি অর্থায়নে জিরো টলারেন্সে সরকার

দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থান নিয়েছে সরকার। জানা গেছে, মুদ্রা পাচার ও চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন হচ্ছে। দেশে সিএসআরের নামে বিভিন্ন জিহাদি প্রকল্পে জঙ্গি-সন্ত্রাসী অর্থায়ন হলেও সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি নেই। আর জঙ্গি অর্থায়নে ব্যাংক-বীমা ও এনজিও খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দাবি, আর্থিক খাতে তাদের কঠোর নজরদারি আছে।

নিরাপত্তা-বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকে সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কর্মসূচি বা করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির (সিএসআর) নামে জঙ্গি অর্থায়ন হচ্ছে। এখানে নজরদারি নেই।

ব্যাংক সিএসআরের নামে যে অর্থ প্রদান করে, তা যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা ও তাদের জঙ্গি-জিহাদি প্রকল্পে। তার মতে, জিহাদিকরণ প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় চ্যারিটির মাধ্যমে অর্থায়ন হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। এই ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করে সরকারি নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে চোরাচালানের মাধ্যমে জঙ্গি-সন্ত্রাসী অর্থায়ন হচ্ছে। অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে এ অর্থায়ন হয়। বৈধ পথে জঙ্গি-সন্ত্রাসে অর্থায়ন করা খুবই কঠিন। তাই অবৈধ বাণিজ্য বা চোরাচালানের উৎসগুলো বন্ধে শুল্ক গোয়েন্দা জিরো টলারেন্স নীতির ভিত্তিতে কাজ করছে। আমরা চোরাচালানের মাধ্যমে জঙ্গি-সন্ত্রাসী অর্থায়নের প্রাথমিক উৎস বা সূত্রগুলো তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে চিহ্নিত করে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নিয়মিত অবহিত করছি।’ তার মতে, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের বিষয়টি এখন সারা বিশ্বে আলোচিত। জানা গেছে, প্রায় তিন মাস আগে পানামা কেলেঙ্কারিতে নাম আসা বাংলাদেশিদের অর্থ পাচারের বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান এনবিআরের কর গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। সেই অনুসন্ধানে মুদ্রা পাচারের সঙ্গে সন্ত্রাসী অর্থায়নের যোগসূত্র খুঁজে পান কর গোয়েন্দারা। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তদন্ত চলমান থাকার কারণে চূড়ান্ত মতামত বা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি সিআইসি। এর আগে থেকেই জঙ্গি-সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ১৮টি ব্যাংক-বীমা ও সেবা খাতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে কড়া নজরদারি রাখছে সরকার। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী জঙ্গি-মৌলবাদী এই অপশক্তিকে অর্থায়নে জড়িতদের ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ইতিমধ্যে খোঁজখবর নিয়ে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করেছে। দেশে জঙ্গি কার্যক্রম ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের উৎস জানতে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তদন্তে নামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে একাধিক মহলের তদবির আর অজানা কারণে সিআইসির সেই তদন্ত পিছুটান দেয় বলে সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। ওই সূত্রের তথ্যমতে, সরকারের আগ্রহে ২০১৪ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সন্দেহজনক সাতটি ব্যাংক, ১১টি বীমা, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক-হাসপাতাল ও দেশি-বিদেশি এনজিওসমূহের আয়-ব্যয়, এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, তাদের করফাঁকি ও অর্থ পাচারের নানা দিক তদন্ত করে অনেক তথ্য পায় সিআইসি। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের (বিএফআইইউ) দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়ে আমাদের নজরদারি সব সময় খুবই কঠোর। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছে। সম্প্রতি জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হলেও অর্থায়ন নিয়ে সেভাবে কোনো সমস্যা হয়নি। যারা স্টুডেন্ট ভিসায় দেশের বাইরে যায়, তাদের নির্দিষ্ট লিমিট দেওয়া আছে। সংশ্লিষ্ট দেশের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের ওই প্রতিষ্ঠানের টিউশন ফি বা অন্যান্য ফি একসঙ্গে নেওয়ার সুযোগ নেই। ধাপে ধাপে নিতে পারছে। বৈদেশিক লেনদেনের ব্যাংক শাখাগুলোও নীতিমালা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে অর্থ আদান-প্রদান করে না। ফলে এসব অর্থ জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ খুব কম।’ তিনি বলেন, ‘স্টুডেন্ট ভিসায় দেশের বাইরে গিয়ে যদি জঙ্গিবাদী কার্যক্রম করে অথবা সেখানে গিয়ে এর সঙ্গে জড়িত হয়, সেটিও খুব কম সংখ্যক। কারণ প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে যতসংখ্যক শিক্ষার্থী দেশের বাইরে যাচ্ছে, সে অনুযায়ী জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সংখ্যা খুবই কম। ফলে আমরা যদি এখন এটিকে আরও কঠোর করি, সে ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের সমস্যা হবে। তবে আমরা বিষয়টির ওপর নজর রাখছি। এমন অভিযোগ যদি আরও পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিবর্তন অথবা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। সাম্প্রতিক সময়ের সবগুলো অভিযোগও আমরা খতিয়ে দেখেছি। সব ব্যাংকের শাখায় আমাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। সন্দেহজনক লেনদেন হলেই নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ব্যাংকের অন্যান্য মাধ্যমের লেনদেনের বিষয়েও সবাইকে সচেতন থাকার নির্দেশ দেওয়া আছে।’ এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুকে সভাপতি করে ‘জঙ্গিবাদের অর্থের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রম অধিকতর সমন্বয়ের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আমির হোসেন আমু জানান, তিনি এখন ওই কমিটিতে সময় দিতে পারছেন না। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত বৈঠক হয়। জঙ্গি অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও জোরালো করতে নতুন এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকারের কাছে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বেশ কয়েকটি এনজিও, বেসরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থ জোগাচ্ছে। জঙ্গিদের অর্থদাতার উৎস অনুসন্ধানে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সূত্রমতে, জঙ্গিগোষ্ঠীকে অর্থদাতাদের একটি তালিকা নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বেসরকারি একটি ব্যাংকসহ একাধিক এনজিও প্রতিষ্ঠান ও জামায়াত প্রভাবিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ তালিকায়। জঙ্গি বিস্তারে নেপথ্য ভূমিকায় থাকা অর্থদাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় বের করতেও দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, জঙ্গি ধরে শেষ করা যাবে না। তাদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস বন্ধ করতে হবে। দেশে জঙ্গিবাদের বিকাশ ও মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠীর অর্থায়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এই সভাপতি। তার মতে, মৌলবাদের অর্থনীতি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এক ঘনীভূত প্রকাশ। মৌলবাদের অর্থনীতি অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিরুদ্ধ। এক কথায়, এ অর্থনীতি বাহাত্তরের সংবিধানের মূল চেতনাবিরোধী। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ‘বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও জঙ্গিবাদ : মর্মার্থ ও করণীয়’ শীর্ষক গবেষণায় বলেছেন, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে যারা জঙ্গিত্বের প্রমোটর, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া এবং বহিষ্কার করতে হবে। মৌলবাদের ২৩১টি বেসরকারি সংস্থার অর্থ আসে বিদেশ থেকে। মৌলবাদী আদর্শে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এখন বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। আর ১৯৭৫ থেকে ২০১৪ এই ৪০ বছরে মৌলবাদের অর্থনীতির মোট পুঞ্জীভূত মুনাফার পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা। মৌলবাদী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ। এ অর্থ দিয়ে তারা ৫ লাখ ফুল টাইম রাজনৈতিক কর্মী নিয়োগ করতে পারে। যদিও পবিত্র কোরআনে জিহাদ বলে কিছু নেই। কিন্তু মৌলবাদী-জঙ্গিরা জিহাদের নামে দেশের ১৩২টি জঙ্গি সংগঠনকে একমঞ্চে আনতে চায়। আল-কায়েদা জঙ্গিদের মূল রাজনৈতিক সংগঠন এবং আইএস তাদের মিলিট্যান্ট।

সর্বশেষ খবর