বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদ দমন করতে হবে জাতীয় স্বার্থে

বাদল নূর

ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদ দমন করতে হবে জাতীয় স্বার্থে

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য এবং উপমহাদেশের বাম রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব প্রবীণ রাজনীতিবিদ ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছেন, দেশের অবস্থা ভালো না। একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছে। নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। বিদেশিরাও রক্ষা পাচ্ছে না। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে দেশে জঙ্গি হামলা চালানো হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদ দমন ও মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হবে। এজন্য এ মুহূর্তে দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।

রাজধানীর বারিধারার বাসায় গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আরও বলেন, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলছে। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। কখন কী হয় বলা যায় না। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সতর্ক হয়ে চলাফেরা করা উচিত। বর্তমানে তার কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। জামায়াত-শিবির জঙ্গি হামলার সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের দলের নিবন্ধন বাতিল করা উচিত। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। কিন্তু মনে হচ্ছে সরকার ইচ্ছা করলেও জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতেই দেশে নাশকতা চালানো হচ্ছে। বিদেশি শক্তি আমাদের দেশে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। আমাদের দেশের কিছু বিপথগামী লোক তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মানুষ হত্যার মতো নিষ্ঠুরতার পথ বেছে নিয়েছে। ধর্মের কথা বলে বিপথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে দেশের তরুণ-যুবকদের। জঙ্গিবাদ বা মানুষ হত্যা ইসলামের দীক্ষা নয়। এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যে কোনো মূল্যে এটি বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, এই জঙ্গিবাদ যাদের সৃষ্টি তারা এটি বন্ধ না করলে এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ হবে না। তবে জঙ্গি হামলায় আর যেন মানুষ মারা না যায়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতেই জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের নাশকতা চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশও এ থেকে রক্ষা পায়নি। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে আরও শক্তিশালী ও কঠোর হতে হবে। মোজাফফর আহমদ আরও বলেন, শোষণহীন ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিকদের দেশ ও জনগণের স্বার্থে কাজ করা জরুরি। গণতন্ত্রের পথ ধরেই সমাজতন্ত্রের দিকে এগোতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পথে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে ছাত্র-যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ব্যক্তিগত জীবনে একমাত্র কন্যাসন্তানের জনক অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তার সহধর্মিণী আমিনা আহমদ এমপি বর্তমানে ন্যাপের হাল ধরেছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আগের মতো চলাফেরা করতে পারেন না। ডাক্তারের পরামর্শ এবং নিয়ম মেনে চলতে হচ্ছে। দিনরাত বিছানায় শুয়ে থাকেন। হাঁটতে পারেন না। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা স্কুলশিক্ষক আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূঞা, মাতা আফজারুন্নেছা। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ হোসেনতলা স্কুল, জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশন, দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ এবং পরে ইউনেস্কোর ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩৭ সালে তার রাজনীতি শুরু। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ’৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন। ওই বছর সাধারণ নির্বাচনে দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থী, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করেন। ’৫৭ সালের ৩ এপ্রিলে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ’৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনামলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করা হয় এবং ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তিনি আত্মগোপন অবস্থায় আইয়ুবের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ’৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। ’৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ’৬৯-এ আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি আইয়ুব খান আহূত রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের একজন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি ’৭৯ সালে এমপি নির্বাচিত হন। ’৮১ সালে ন্যাপ, সিপিবি ও প্রগতিশীল শক্তির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রাক্কালে কারারুদ্ধ হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, ভারত, দক্ষিণ ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বহু দেশ সফর করেন। তিনি সমাজতন্ত্র কী এবং কেন প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথাসহ বেশ কিছু বই ও পুস্তিকা রচনা করেছেন। বর্তমানে তার গবেষণার বিষয় নতুন শতাব্দীতে নতুন সভ্যতা জন্ম নিচ্ছে। তিনি দেশপ্রেমিক কর্মী সৃষ্টির জন্য ঢাকার উপকণ্ঠে মদনপুরে উপমহাদেশে একমাত্র শিক্ষায়তন সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সর্বশেষ খবর