বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

চার ধাপের প্রশিক্ষণে আত্মঘাতী জঙ্গি

সাঈদুর রহমান রিমন

চার ধাপের প্রশিক্ষণে আত্মঘাতী জঙ্গি

ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের টার্গেটে বাংলাদেশি ধনাঢ্য পরিবারের শিক্ষিত তরুণরা। ব্রেন ওয়াশের পর নানা কৌশলে তাদের জঙ্গি সংগঠনে ভেড়ানো হচ্ছে। চার ধাপের দীর্ঘমেয়াদি কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে তারা হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী। ছোট অস্ত্র থেকে শুরু করে ভারী অস্ত্র চালনাসহ গ্রেনেড চার্জেও এরা হয় পারদর্শী। এ ছাড়া ধারালো অস্ত্র চালনার ক্ষেত্রেও এরা হয় ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন। টার্গেট কিলিং থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য প্রশিক্ষিত আত্মঘাতী জঙ্গিরা থাকে সর্বদা প্রস্তুত। পরিবার-পরিজন, মায়া-মমতা পেছনে ফেলে এবং নিজেদের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে সংগঠনের নেতাদের নির্দেশ তারা পালন করে অক্ষরে অক্ষরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য দিয়ে বলেছে, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলা ছাড়াও সাম্প্রতিককালে জঙ্গি হামলাগুলো ঘটিয়েছে ভয়ঙ্কর আত্মঘাতীরাই। এরা জীবন দিয়ে তাদের টার্গেট পূরণ করে। ১ জুলাই গুলশানের আর্টিজানে হামলাকারীরাও আত্মঘাতী গ্রুপের সদস্য ছিল বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। সূত্র জানায়, সংগঠনের নামে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে নিয়মিত হুমকি-ধমকি প্রদান, জনাকীর্ণ স্থানে বোমাবাজি চালানোসহ নানারকম কর্মকাণ্ড সাধারণ জঙ্গিরাই করে থাকে। আর অবসর সময়ে শুধু সংগঠনের বিস্তার ঘটাতে প্রলুব্ধ করে চলে সহপাঠী, পরিচিত ও ফেসবুক বন্ধুদের। সফল হলেই নতুন সদস্যকে রিক্রুট করে প্রথম ধাপের প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উত্তীর্ণরা দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ পর্বের চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকে। বিভিন্ন সময় গ্রেফতার জঙ্গিদের বরাত দিয়ে গোয়েন্দারা জানান, দেশের অভ্যন্তরেই প্রথম ধাপের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা জনবহুল স্থানে বোমাবাজি চালিয়ে নির্বিঘ্নে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া, কোনো মিছিল-মানববন্ধন, জনসভা আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে ভণ্ডুল করে দেওয়া, টার্গেট ব্যক্তিকে ধাওয়া দিয়ে বা মারধর করে আতঙ্কিত করার মতো প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মকাণ্ড সাধনের উপযোগী করে তোলা হয়। প্রথম দফার প্রশিক্ষণ শেষেই তাদের মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়নের পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে হয়। এতে সফল হলেই জঙ্গি সদস্যদের দ্বিতীয় ধাপের প্রশিক্ষণ নিতে দেশের অভ্যন্তরেই পাহাড়ি আস্তানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে টানা তিন মাস ধরে অপেক্ষাকৃত কঠোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে, ২০১১ সালে ব্যর্থ সামরিক ক্যু ঘটানোর অন্যতম নায়ক মেজর জিয়াউল ইসলামের নেতৃত্বে কতিপয় তালেবান যোদ্ধা দ্বিতীয় ধাপের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সেখানে সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের প্রশিক্ষণে দেশি অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যেই টার্গেট কিলিং ঘটানো, দীর্ঘ পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো, গণপিটুনির শিকার হলেও তা থেকে জীবন বাঁচানো, টার্গেট ব্যক্তিকে অপহরণ করে নির্দ্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত পৌঁছানোর নানা কৌশল রপ্ত করে জঙ্গিরা। পাহাড়ি প্রশিক্ষণ শেষ হলেই সফল জঙ্গি সদস্যদের তৃতীয় ধাপ ও চূড়ান্ত পর্যায়ের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাছাইকৃত সদস্যদের বেশির ভাগই তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় আইএস অধিকৃত এলাকায় পৌঁছে থাকে বলে জানা গেছে।

২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে জঙ্গি প্রশিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন জঙ্গি কমান্ডার আবদুল মালেক, হিযবুল মুজাহিদের সামরিক কমান্ডার মো. শাফী ওরফে সামিউল্লাহ ওরফে মোশতাক, মাজেদ ভাটসহ পাঁচ জঙ্গি কমান্ডার। আবদুল মালেক পাকিস্তানভিত্তিক অত্যন্ত শক্তিশালী জঙ্গি সংগঠন ‘লস্কর-ই-তৈয়বা’র চিফ কমান্ডার। সংগঠনের নেতা-কর্মী ও অস্ত্রবাজ সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন নামে তাকে চেনে- জানে। আবদুল মালেক ওরফে গোলাম রহমান ওরফে জিএম— এমন কয়েকটি নাম রয়েছে তার। সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র চালনার ক্ষেত্রে খুবই পারদর্শী মালেকের জন্মস্থান সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা ইন্দ্রনগর গ্রামে। তার পিতার নাম সামসুর রহমান।

সূত্র জানায়, পাশের একটি দেশে অবস্থানকালে জঙ্গি কমান্ডার আবদুল মালেক ২০০০ সালে লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় তার কঠোর প্রশিক্ষণ চলে। সর্বত্রই দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে অস্ত্র চালনায় হয়ে ওঠেন অদ্বিতীয়। প্রশিক্ষণ শেষে ২০০৩ সালে তিনি বাংলাদেশে পা দিয়েই বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ১০টিরও বেশি প্রশিক্ষণ সেন্টার গড়ে তোলেন। পরে র‌্যাবের অভিযানে কমান্ডার মালেক গ্রেফতার হলেও তার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো অক্ষত থাকে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের নাগরিক কমান্ডার মো. শাফী ওরফে সামিউল্লাহ ওরফে মোশতাকের দায়িত্বে এ দেশীয় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো চালানো হতো দুর্গম চরাঞ্চলসমূহে। সীমান্তবর্তী ব্রহ্মপুত্র নদ ও গাইবান্ধা-জামালপুর এলাকায় যমুনা নদীর দুর্গম চরসমূহে বেশ কয়েকটি জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির থাকার নানা তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে পৌঁছে। সেসব এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েও খুব বেশি সফল হতে পারেনি। এদিকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানায়, দেশীয় জঙ্গিদের সঙ্গে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিদের ধর্মীয় যোগসূত্রে পারস্পরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র লেনদেন ঘটে চলেছে। কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে গড়ে ওঠা রোহিঙ্গা শিবির এবং বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের অবৈধ জনবসতি এলাকাতেও জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকার অভিযোগ রয়েছে। সেসব স্থানে আরএসও কমান্ডারদের সহযোগিতায় নানা ধরনের অস্ত্র চালনা শিক্ষা দেওয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর