বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

অস্ত্র উদ্ধারে দেশজুড়ে অপারেশন আইরিন

রুহুল আমিন রাসেল

দেশে এখন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনছেন ‘অস্ত্র আমদানিকারক’ ব্যবসায়ীরা। সেই অস্ত্র গোলাবারুদ যাচ্ছে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে। এমন বেশ কিছু অস্ত্রের সন্ধানও মিলেছে সারা দেশে শুল্ক গোয়েন্দার চলমান বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন আইরিন’-এ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩৩টি দেশে একযোগে চলছে অপারেশন আইরিন। এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশে এ অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, “মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ আমদানি ঠেকাতে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। মূলত এ ধরনের অস্ত্র উদ্ধারে রিজিওনাল ইন্টেলিজেন্স লিসন অফিস ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (রাইলোএপি) উদ্যোগে এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৩৩টি দেশ একযোগে ‘অপারেশন আইরিন’ নামে এ অভিযান পরিচালনা করছে। রাইলোর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে ৮ জুলাই থেকে শুল্ক গোয়েন্দার একাধিক দল এ বিশেষ অভিযানে সক্রিয় রয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দার এ অভিযানে ইতিমধ্যে বেশ কিছু অস্ত্র পাওয়া গেছে।” নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্বে প্রতি বছর কালোবাজারে অস্ত্রের প্রায় ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা হয়। বৈধভাবে না আসা এ অস্ত্র কোথায় ব্যবহার হয় তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এসব অস্ত্রের চোরাচালান রোধে সব দেশ সক্রিয় না থাকলে ঝুঁকি আছে। এমন প্রেক্ষাপটে শুল্ক গোয়েন্দার এই অপারেশন জননিরাপত্তা ও বিশ্ব নিরাপত্তার কারণ আছে। মিথ্যা ঘোষণায় অস্ত্র আমদানি শক্ত হাতে দমন করতে হবে। এ অভিযান অস্ত্র চোরাচালান কমাতে সহায়তা করবে বলে মনে করেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের অবদান ও উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ধরে রাখতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে অবৈধ হালকা অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকদ্রব্য পাচার রোধে এ অভিযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে দুষ্কৃতকারী ও পাচারকারী চক্রের কাছে এ অভিযান বাংলাদেশ কাস্টমের পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা দেবে বলে মনে করে শুল্ক গোয়েন্দা। তবে বাংলাদেশ ফায়ার আর্মস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (প্রস্তাবিত) সদস্য ও পুরানা পল্টনের মইন ফায়ার আর্মসের মালিক নারায়ণ চন্দ্র দাস গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় অস্ত্র আমদানির অভিযোগ সঠিক নয়। কারণ ঋণপত্র বা এলসি দিয়ে আমদানি হলে মিথ্যা ঘোষণার ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু আমরা যারা আমদানি করছি, তারা তো আগে নগদ টাকা পাঠিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের অনুমোদন নিয়ে অস্ত্র আমদানি করছি। আবার যে কোনো দেশ চাইলেই বাংলাদেশে অস্ত্র রপ্তানি করতে পারে না। এর পরও যদি কেউ এ ধরনের অনিয়ম করে থাকে, তাদের শুল্ক প্রশাসনের ধরা উচিত।’

শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিগত তিন বছরে বিভিন্ন দেশের কাস্টম কর্তৃপক্ষ হাজারেরও বেশি অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকের চালান আটক করেছে। এনফোর্সমেন্ট কমিটি অব দ্য কাস্টমস কো-অপারেশন কাউন্সিলের এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এ ধরনের আটকের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। ওই কমিটির ৩৫তম সভার সিদ্ধান্তের আলোকে অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, মাদক ও অন্যান্য অবৈধ ও নিরাপত্তার ঝুঁকি-সংবলিত পণ্যের ব্যবসা বা পরিবহন রোধকল্পে চলতি ৪ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত তিন সপ্তাহ অপারেশন আইরিন নামে একটি আঞ্চলিক অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।

ওই অভিযান বিশ্ব শুল্ক সংস্থার (ডব্লিউসিও) অধীনে রাইলো সার্বিকভাবে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশও রাইলোএপির অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য হিসেবে এ অভিযানে অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট রাইলোএপির ন্যাশনাল কন্ট্রাক্ট পয়েন্টের (এনসিপি) অভিযানের বিষয়টি সার্বিকভাবে সমন্বয় করছে। শুল্ক গোয়েন্দা এ অভিযানের অংশ হিসেবে পোস্টাল ও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আনা পার্শেলসমূহের স্ক্যান কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। অভিযান জোরদার করতে আজ ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর ফ্রেইট ইউনিটের কুরিয়ার ও পোস্টাল শাখায় আসা পার্শেলসমূহ র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড নিয়ে বিশেষ তল্লাশি করা হবে। তল্লাশি শেষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অপারেশন আইরিনে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরবে শুল্ক গোয়েন্দা। জানা গেছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সন্ত্রাসী হামলাসহ নানা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড নিরাপত্তা বিঘ্নিতসহ সমাজে ভারসাম্য নষ্ট করছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নকারী এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, মাদক ইত্যাদি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণা ও ঘোষণাবিহীনভাবে এসব অবৈধ পণ্য চোরাচালান হওয়ার নজির রয়েছে। চোরাকারবারিরা অবৈধ পণ্য নানা কৌশলে পাচারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে অনলাইনে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে পোস্টাল ও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে এসব পণ্য পরিবহনের গোপন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

সুইডেনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা সিপ্রি প্রকাশিত ‘ট্রেন্ডস ইন ইন্টারন্যাশনাল আর্মস ট্রান্সফারস, ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বৈশ্বিক অস্ত্র লেনদেনের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে বলা হয়, বিশ্বে অস্ত্রের বাণিজ্য ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের আগের পাঁচ বছরের তুলনায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে ৬১ শতাংশ। শীর্ষ ১০ অস্ত্র আমদানিকারক দেশের ছয়টি এশিয়ার। সংঘাত, সমরাস্ত্র, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে স্বাধীনভাবে গবেষণায় জড়িত সিপ্রি ফেব্রুয়ারিতে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, শীর্ষ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর চীনের অবস্থান। আর চীনের প্রধান তিন অস্ত্র আমদানিকারক দেশের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। প্রথম পাকিস্তান।

সর্বশেষ খবর