শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

নিখোঁজ হয়েই জঙ্গি

কেউ যায় সিরিয়ায় কেউ মালয়েশিয়া, দেশে প্রশিক্ষণ গাইবান্ধা-ঝিনাইদহে, চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বের হচ্ছে

মির্জা মেহেদী তমাল

নিখোঁজ হয়েই জঙ্গি

হঠাৎ করেই ঘর পালিয়ে ভয়ঙ্কর তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছে ওরা। নিজেরা বিপজ্জনক কাজ করা ছাড়াও পরিবারকে ফেলে দিচ্ছে বিপদের মুখে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এরই মধ্যে নিখোঁজ অনেকের নাম ছবি প্রকাশ করেছে। আরও অনেকের নাম প্রকাশের অপেক্ষায়। ১৪০ অথবা দুই শতাধিক-নিখোঁজের এই সংখ্যা নিয়ে নিশ্চিত না হলেও নিখোঁজদের নামের এই তালিকা ক্রমশ বড় হচ্ছে। ঘর পালানোদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সব মহলেই এখন প্রশ্ন— নিখোঁজেরা জঙ্গি হওয়ার জন্য যায় কোথায়?

সংশ্লিষ্টরা বলছে, লাপাত্তা বনে যাওয়া তরুণ-যুবকদের অধিকাংশই জঙ্গি সংগঠনগুলোতে যোগ দিয়েছে। এদের কেউ গেছে সিরিয়া আর মালয়েশিয়ায়। আবার কেউ ঝিনাইদহ আর গাইবান্ধায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলেও গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে। এদের মধ্যে গুলশান রেস্তোরাঁয় নিহত জঙ্গি নিবরাস ঝিনাইদহে প্রশিক্ষণসহ বেশ কয়েকটি হামলায় জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় ছয় জঙ্গি নিহত হওয়ার পর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। তাদের পরিবারের কাছ থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জানতে পারে, এরা প্রত্যেকেই হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছিল। নিহত হওয়ার পর পরিবার জানতে পারে, তাদের সন্তানরা কয়েক মাসের মধ্যেই ভয়ঙ্কর জঙ্গি হয়ে ওঠে। এরপরই পুলিশ ও গোয়েন্দারা নিখোঁজদের জঙ্গি হয়ে ওঠার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। সর্বশেষ ফাঁস হওয়া মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের ১৭৫০ বিদেশি জঙ্গির তথ্যসংবলিত গোপন নথিতে দেখা যায় সাত বাংলাদেশি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে নিহত হয়েছে। এরাও গোপনে দেশ ছেড়ে সিরিয়ায় আইএস-এ যোগ দিয়েছিল। দেশের একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনারের ছেলেসহ ৩ তরুণ সিরিয়া যাওয়ার উদ্দেশে এখন তুরস্কে। পরিবারের কাছে না জানিয়েই আইএসএ যোগ দিতে এরাও গোপনে দেশ ছাড়ে। এই তিন তরুণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জানিয়েছে, আর্টিজানের মতো হামলা বাংলাদেশে আরও হবে। এ খবরের পর পুলিশ এদের খোঁজে এখন মাঠে নেমেছে। গত শনিবার ফাঁস করা ১০ নিখোঁজ তরুণের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে পুলিশ জানতে পারে, এরাও ঘর থেকে পালিয়েছে। এই ১০ জনই জঙ্গি তৎপরতায় রয়েছে বলে গোয়েন্দাও পুলিশের কাছে খবর রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের কর্মকাণ্ড নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, ইসলামিক স্টেট বা আইএসের বাংলাদেশে কোনো কর্মকাণ্ড না থাকলেও বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশিরা এই জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছে। শুধু যোগ দেওয়াই নয়, তারা অংশ নিচ্ছে সক্রিয় যুুদ্ধে। এমনকি আইএসের যুদ্ধ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাম জড়িয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সাতজন। তাদের দুজন বাংলাদেশ থেকে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যায়, বাকি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকরা গেছে যুক্তরাজ্য থেকে। আর সর্বশেষ ফাঁস হওয়া আইএসের ১৭৫০ বিদেশি জঙ্গির তথ্যসংবলিত গোপন নথিতে পাওয়া গেছে বাংলাদেশিদের জীবনবৃত্তান্ত। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিভিন্ন দেশের নাগরিকের সরাসরি ইরাক বা সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের হয়ে লড়াই করার তথ্য গোয়েন্দারা পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। এই দলে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একাধিক নারী। এ ছাড়া কয়েকজনের লন্ডন বা ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অবস্থান করে আইএসের পক্ষে আর্থিক বা কারিগরি ব্যবস্থাপনা চালানোর তথ্যও পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের এপ্রিলে ইরাক, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বড় একটি এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে খিলাফত কায়েমের ঘোষণা দেয় আইএস। কয়েক হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আইএস ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণ-তরুণীকে নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছে। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র আশেকুর রহমান ওরফে জিলানী আইএসে যোগ দেন। তার আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায় ২০১৫-এর শুরুতে। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি আশেকুর একটি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা বলে গিয়েছিলেন তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে। কিন্তু এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। ধারণা করা হচ্ছে, ইস্তাম্বুল থেকেই সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছেন আশেকুর। এরপর গত ১০ ডিসেম্বর আইএসের কথিত রাজধানী সিরিয়ার রাকা প্রদেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় নিহত হন বাংলাদেশি সাইফুল হক। বাংলাদেশি এ তরুণ ২০০৩ সালে শিক্ষা ভিসায় ঢাকা থেকে লন্ডনে যান। পরে যুক্তরাজ্যে ১০ বছর অবস্থান করেন সাইফুল হক। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি কার্ডিফে ছিলেন। ঢাকায় ছিল সফটওয়্যারের ব্যবসা। তার স্ত্রী ও এক ছেলে রয়েছেন। ব্রিটেনে অভিবাসনের জন্য আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়া সাইফুল হক ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ হয়ে সিরিয়ায় চলে যান। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সাইফুল আইএসের হ্যাকিং দলে যোগ দেন। একপর্যায়ে প্রধান হ্যাকারের মৃত্যু হলে সাইফুলই হয়ে যান আইএসের হ্যাকারদের প্রধান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আইএসবিরোধী যুদ্ধে ফেলা আকাশবোমায় আরও নয়জন শীর্ষ আইএস জঙ্গির সঙ্গে নিহত হন সাইফুলও। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশি ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের আইএসে যোগ দিয়ে নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া না যাওয়ায় ঘনিষ্ঠরা ধারণা করেন, তাদেরও মৃত্যু হয়েছে। তবে আইএসের অনলাইন ম্যাগাজিন ‘দাবিক’-এর সর্বশেষ সংস্করণের এক নিবন্ধে এক বাংলাদেশির যুদ্ধে নিহত হওয়ার তথ্য উঠে আসে। বাংলাদেশি এ তরুণের ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তবে প্রকাশ হয়নি প্রকৃত নাম। নাম বলা হয়েছে আবু জান্দাল আল-বাঙালি। গোয়েন্দারা মনে করছেন, ঢাকা থেকে সিরিয়া যাওয়ার পর নাম পরিবর্তন করে আবু জান্দাল রাখা হয়েছে এবং যেহেতু বাংলাদেশি তাই নামের শেষে আল-বাঙালি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরই আরেক বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর প্রকাশ করে আইএস। ওই বাংলাদেশির নাম আবু দোজানা আল-বাঙালি। তবে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নথি বলছে, তার প্রকৃত নাম মেহেদী হাসান। সিরিয়া যাওয়ার পর নামকরণ হয়েছে আবু দোজানা আল-বাঙালি। মেহেদী হাসান ছাড়াও মারা যান মামুনুর রশিদ, হামিদুর রহমান, মাসুদুর চৌধুরী ও আসাদুজ্জামান।

ঢাকায় বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনায় নিহত জঙ্গিদের বিষয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা জানতে পারে অভিন্ন কাহিনী। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এসব হামলাকারী সবাই তরুণ এবং হামলা বা হত্যাকাণ্ডের পর যারা গ্রেফতার অথবা নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারের কাছ থেকে জানা যায়, এরা সবাই ঘটনার অনেকদিন আগে থেকেই নিখোঁজ। পরিবার তাদের সন্তানদের খুঁজতে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন। কিন্তু তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। যখন সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তখনই তাদের খোঁজ মিলেছে।

আরও ঘটনা : রাজধানীর খিলগাঁওয়ে মেরাদিয়া এলাকায় ১৯ জুন ডিবি পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন শরিফুল ওরফে সালেহ ওরফে আরিফ (৩০)। সে বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে মূল পরিকল্পনাকারী এবং নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত। ঢামেক মর্গে লাশ শনাক্ত করতে এসে শরিফুলের দুলাভাই হেদায়েতুল ইসলাম ও চাচাতো ভাই রহমত আলী জানিয়েছেন তার নাম মুকুল রানা। সে চার মাস ধরে নিখোঁজ ছিল। এ ঘটনার ঠিক কয়েকদিন আগে মাদারীপুরে সরকারি নাজিম উদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক রিপন চক্রবর্তীকে গত ১৫ জুন কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা হয়। হত্যা চেষ্টার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিম (১৯) নামে একজনকে জনতা আটক করে পুলিশের কাছে তুলে দেয়। পরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৮ জুন শনিবার সকাল ৭টার দিকে সে নিহত হয়। এর আগে ১১ জুন তার বাবা গোলাম ফারুক ছেলে ফাইজুল্লাহ বাসায় না ফেরায় রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় জিডি করেন। জিডিতে উল্লেখ করেন, ১১ জুন বেলা সাড়ে ১০টার দিকে টঙ্গীতে বন্ধু শাকিলের কাছে প্র্যাকটিক্যাল খাতা নেওয়ার নাম করে বাসা থেকে বের হয় ফাইজুল্লাহ। এরপর ফোনে জানায়, বিশেষ কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছে। এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সময় না থাকায় আর দেখা হলো না। বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে। মায়ের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেয়। একটি রবি নম্বর থেকে তার বাবাকে সে একটি মেসেজ দিয়েছিল। সাম্প্রতিক গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচজনই নিজ নিজ বাসা থেকে নিখোঁজ হয় ঘটনার ৫ থেকে ৬ মাস আগে থেকে। এ ছাড়া শোলাকিয়ায় নিহত জঙ্গি আবির তার ঢাকার বাসা থেকে নিখোঁজ হয় জানুয়ারিতে।

সর্বশেষ খবর