শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছে পুলিশ

উদ্বিগ্ন স্বজনরা

মাহবুব মমতাজী

ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছে পুলিশ

গুলশান ও শোলাকিয়ায় পরপর দুটি জঙ্গি হামলার ঘটনায় রাজধানীতে নিরাপত্তা জোরদারে আগের চেয়ে দায়িত্ব বাড়ানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা

রক্ষাকারী বাহিনীর। এতে তাদের বেড়েছে পেশাগত ঝুঁকিও। প্রতিটি তল্লাশি চৌকিতে পুলিশ ও র‌্যাবের সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের সার্বক্ষণিক হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটসহ রাখা হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়। প্রায় প্রত্যেক পথচারীকে থামিয়ে করা হচ্ছে দেহ তল্লাশি। ব্যাগধারী প্রত্যেকের গতিবিধির ওপর চলছে তীক্ষ নজরদারি। ডিউটি অবস্থায় প্রত্যেকের অস্ত্র, হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটসহ সতর্ক থাকা জরুরি মর্মেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সন্দেহজনক মনে হলে আগাগোড়া তল্লাশি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বিরল-বিরাম পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্য ইতিমধ্যে অসুস্থও হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাও নিয়েছেন। বেশির ভাগই ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি ও মাথা ধরায় ভুগছেন।

জানা গেছে, গুলশানে হামলার ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদে নিজ নিরাপত্তার জন্য ফোর্স চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দুই হাজার আনসার সদস্য চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। বিশেষ করে দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে পুলিশের সহায়তার জন্য এসব আনসার সদস্য চাওয়া হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার কারণে ঢাকার বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা রক্ষায় প্যাট্রলিং, তল্লাশি চৌকি, ব্লক রেইড, তল্লাশি অভিযান, দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি। পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যের স্বল্পতা আপাতত আনসার দ্বারা পূরণ করতে চাইছে ডিএমপি। রাজধানীতে দিন-রাত প্রতিটি মুহূর্তে প্রায় সমানভাবে ২০-৩০টি পয়েন্টে চলছে কঠোর তল্লাশি। এসব পয়েন্টে দায়িত্বরত সাইফুল, কামরুল, সুমন, ফজলুল, ইকবালসহ কথা হয় একাধিক পুলিশ এবং র‌্যাব সদস্যের সঙ্গে। তারা জানান, আগে যেখানে ডিউটি করতে হতো ৮ ঘণ্টা, খুব বেশি হলে ১২ ঘণ্টা আর এখন ডিউটি করতে হচ্ছে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা। মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক ছুটি কাটানো যেত এখন আর তার সুযোগ নেই। আবার ডিউটি পালনেও কড়াকড়ি। সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকতে হচ্ছে। জীবনের ঝুঁকির কারণে ইউনিফর্ম গায়ে একা একা কোথাও যেতে পারছেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানান, দিনের বেলায় তীব্র গরমের মধ্যে এক নাগাড়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে থাকতে হচ্ছে। খাওয়া ছাড়া এক মুহূর্তও বিশ্রাম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এতে তাদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কেউ কেউ রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। অভিজাত এলাকা গুলশানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে জঙ্গি হামলার ঘটনায় চরম উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যারা নিয়োজিত সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বজনরাও এখন প্রতিনিয়ত উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। দিন কাটাচ্ছেন। গুলশান ও শোলাকিয়ায় পরপর দুটি জঙ্গি হামলার শুরুতে পুলিশ লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় সন্তানকে অভিভাবকদের কেউ কেউ পুলিশের চাকরিতে যেতে দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। জানা গেছে, দেশের জরুরি প্রয়োজনে নিজেদের ওপর আরও বেশি নাগরিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত দায়িত্ব অর্পণ হওয়ায় পুলিশ সদস্যরা ঠিকমতো পরিবারেও সময় দিতে পারছেন না। গুলশানের ঘটনায় অনেকের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে। কর্তব্যের ভার বৃদ্ধি পাওয়ায় পুলিশের নিকটজনদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বহুগুণে বেড়ে গেছে বলেও জানান একাধিক পুলিশ সদস্য। এ নিয়ে কথা হয় খিলগাঁওয়ে বসবাস করা পুলিশের এক উপ-পরিদর্শকের (এসআই) স্ত্রীর সঙ্গে। তার চোখেমুখে ছিল দুশ্চিন্তার ছাপ। অনেকটা ভারী কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ঈদের দিনেও সে (স্বামী) ডিউটি করেছে। ঈদে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল, পরে তা সম্ভব হয়নি। এখন ঠিকমতো বাসায় আসারও সুযোগ পায় না। ফিরলেও তা অনেক রাতে। যখন ডিউটিতে থাকে সারাক্ষণ ওর জন্য চিন্তা হয়। শুধু আমি না আমার শ্বশুর-শাশুড়িও চরম দুশ্চিন্তায় থাকেন।’ গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় আহত পুলিশ সদস্য আলমগীরের এক স্বজন জানান, ‘অন্যের নিরাপত্তা দেওয়া যে ছেলের চাকরি, এখন তার নিরাপত্তা কে দেবে? তার আহতের বিষয়টি প্রথমে আমরা জানতে পারিনি। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের খবর দেওয়া হয়েছে। আলমগীর তো অল্পের জন্য সেদিন রক্ষা পেয়েছে। সুস্থ হয়ে যখন সে ফের ডিউটিতে যাবে সারাক্ষণ আমরা অস্থির থাকব।’ পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদে নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল বের হয়েছে ২২ জুন। ঈদের পর থেকে উত্তীর্ণদের নিজ এলাকার ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন সংগ্রহের কাজ চলছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর আগামী মাসের মাঝামাঝি এক বছরের বাস্তব প্রশিক্ষণের জন্য সারদা পুলিশ প্রশিক্ষণ একাডেমিতে পাঠানোর কথা। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনায় পরিবেশ পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণে নিজের ছেলেকে ট্রেনিংয়ে পাঠাবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন উত্তীর্ণ এক প্রার্থীর বাবা আবদুল জব্বার। পেশায় কলেজশিক্ষক। গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। আবদুল জব্বার বলেন, ‘এখন যা শুরু হয়েছে দেশ-বিদেশে সবখানে নিচ থেকে শুরু করে উপর পর্যন্ত সবাই চিন্তার মধ্যে আছে। আমিও এর বাইরে নই। পরপর দুটি ঘটনায় পুলিশ যেভাবে আক্রমণের শিকার হয়ে আহত-নিহত হয়েছে সেই থেকে আমরা আমাদের ছেলেকে এই ঝুঁকিপূর্ণ চাকরি করাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।’ পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দুটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আক্রমণের শিকার হওয়ায় এখন তা নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। নিজেদের পেশাদারিত্বে ঝুঁকিও বেড়েছে কয়েক গুণ। এর মধ্যে তারা যদি নিজেদের নিরাপদ রাখতে না পারেন তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন কীভাবে। তা নিয়েও বেশ চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। নিজ সদস্যদের নিরাপত্তার পাশাপাশি জনগণের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিধানের বিষয়ে দফায় দফায় পুলিশ কর্মকর্তাদের বৈঠক চলছে ডিএমপি ও পুলিশ সদর দফতরে। ১ জুলাই গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় প্রথমে গুরুতর আহত হন দুই পুলিশ সদস্য মো. আলমগীর ও প্রদীপচন্দ্র দাস। তত্ক্ষণাৎ তাদের ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের অবজারভেশন কক্ষে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে ছাড়পত্র দিয়ে পাঠানো হয় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে। এরপর দুই পক্ষের গোলাগুলিতে আহত হন আরও ৫০ জন পুলিশ সদস্য। একই ঘটনায় জঙ্গিদের গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন। পাঁচ দিন পরই, ঈদের দিন দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে আবারও চালানো হয় জঙ্গি হামলা। ঘটনায় জহিরুল ইসলাম (৩২) ও আনছারুল ইসলাম নামে দুই পুলিশ সদস্য নিহত ও ছয় সদস্য গুরুতর আহত হন। জানা গেছে, শোলাকিয়া ঈদগাহে প্রবেশপথের প্রায় ১০০ গজ দূরে চেকপোস্টে পুলিশের সদস্যরা চেক করার সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে জঙ্গিরা। এতে পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে শুরু হয় দুই পক্ষের গোলাগুলি। এ সময় জঙ্গিরা হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটালে পুলিশ সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এ ঘটনায় আট পুলিশসহ নয়জন আহত হন। তাদের উদ্ধার করে কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পুলিশ সদস্য জহিরুল ইসলামকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আনছারুল ইসলাম নামে আরও এক পুলিশের মৃত্যু হয়।

সর্বশেষ খবর