শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঝিনাইদহের ‘সাঈদ’ই গুলশানের ঘাতক নিবরাস

শেখ রুহুল আমিন, ঝিনাইদহ

ঝিনাইদহের ‘সাঈদ’ই গুলশানের ঘাতক নিবরাস

ঝিনাইদহ শহরের সোনালীপাড়ায় একটি বাড়িতে মেস ভাড়া নিয়ে বাস করত জঙ্গি নিবরাস ইসলাম। এলাকাবাসী জানায়, চার মাস আগে সে ও তার সঙ্গীরা এ বাড়ির দুটি কামরা ভাড়া নিয়ে ‘ছাত্রাবাস’ গড়ে তোলে। ও সময় নিবরাসের নাম ছিল সাঈদ। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা বলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা কাওসারের ওই বাড়ি ভাড়া নেয় সাঈদ। জঙ্গি নিবরাসকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে বাড়ির মালিক ও তার দুই সন্তানসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। এর পর থেকে ওই পাঁচজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন পরিবারের সদস্যরা। এ পাঁচজন হলেন বাড়ির মালিক কাওসার আলী (৫০), তার বড় ছেলে ঝিনাইদহ সিটি কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের ছাত্র বিনছার আলী (২৪) ও ছোট ছেলে নারিকেলবাড়িয়া কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র বেনজির আলী (২২), সোনালীপাড়া জামে মসজিদের ইমাম রোকনুজ্জামান ও সাব্বির নামে এক হাফেজ।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর বাড়ির মালিক বুঝতে পারেন নিহত জঙ্গিদের একজন নিবরাস ইসলাম ‘সাঈদ’ নাম ধারণ করে এ ছাত্রাবাসে থাকতেন। জঙ্গিদের ছবি দেখে তাকে এলাকার অনেকেই চিনতে পারেন। ছাত্রাবাসটির সামনের মাঠে প্রায়ই বিকালে ফুটবল খেলত নিবরাস। তার আচরণে এলাকার লোকজন কখনো বুঝতে পারেননি যে নিবরাস জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত।

সোনালীপাড়ায় বসবাসকারী ও সরকারি কে সি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নওরজামিন বর্ষণ জানান, প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রাবাসের পাশের খেলার মাঠে তারা ফুটবল খেলতেন। চার মাস আগে ওই নিবরাস নিজেকে সাঈদ নামে পরিচয় দিয়ে ওই মাঠে যেত এবং তাদের সঙ্গে খেলা করত। সে ইবির ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ছাত্রাবাসে থাকত বলে সবাইকে বলত। সে ভালো ইংরেজি বলতে পারত। ‘গুলশান ঘটনার পর ছবি দেখে চমকে উঠি— সাঈদই তো গুলশানের ঘাতক নিবরাস!’

বাড়ির মালিকের স্ত্রী বিলকিস নাহার জানান, ‘দুটি কামরা প্রতি মাসে ২৩০০ টাকায় ভাড়া করে আটটি ছেলে থাকত। চার মাস আগে ওরা আসে। ঈদের আগে সবাই চলে যায়। এর মধ্যে পাঁচজন ঈদের প্রায় ২০ দিন আগে বাড়ি যাওয়ার নাম করে চলে যায়। আর বাকি তিনজন ২৮ রোজায় মেস ত্যাগ করে। মেসের সবকিছুর দায়িত্বে ছিল সাঈদ নামে এক ছেলে। তার কাছ থেকে ভাড়া বুঝে নিতাম। সে জানিয়েছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছে।’ বিলকিস নাহার জানান, ‘আমরা সবাইকে চিনতাম না। প্রতিনিয়ত তারা স্কুল-কলেজে যাতায়াত করত। বাইরে ঘোরাফেরা করত। তাদের আচার-আচরণেও আমরা কোনো প্রকার জঙ্গিবাদের প্রমাণ পাইনি। আমার স্বামী ও দুই ছেলে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর বাসার মধ্যেই সময় কাটে আমার স্বামীর। নামাজের সময় বাড়ির পাশে মসজিদে নামাজ পড়তেন আবার বাসায় ফিরে আসতেন। আমার দুই ছেলেও নামাজ পড়ে।’ তিনি জানান, ‘গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর ঈদের আগের দিন ৬ জুলাই রাত ১টার দিকে পুলিশ ও র‌্যাবের পোশাক পরিহিত ১০-১২ জন সদস্য বাসার গেটে শব্দ করেন। এ সময় বাইরে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিলে আমার স্বামী দরজা খুললে তারা বাসার ভিতরে প্রবেশ করেন। ছাত্রাবাসের বিভিন্ন রুমে তল্লাশি করে কিছু না পেয়ে রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমার স্বামী, দুই ছেলে ও মসজিদ থেকে ইমাম ও এক হাফেজকে ধরে নিয়ে যান। এর পর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ পাইনি।’

সোনালীপাড়ার বাসিন্দা শামছুল ইসলাম জানান, ছাত্রাবাসের ছেলেগুলোর চলাফেরা, আচার-আচরণ দেখে সহজ-সরল নিরীহই মনে হতো। তারা সবাই নামাজ পড়ত।

৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার করাতিপাড়া গ্রামের আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি খুন হন। নিহত আনন্দ গোপালের বাড়ি ও নিবরাস ইসলাম ওরফে সাঈদ যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সেই বাসার মালিক কাওছার আলী মোল্লার বাড়ি একই গ্রাম বাগডাঙ্গা করাতিপাড়ায়। এ নিয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মাঝে নানা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নজর ফাঁকি দিয়ে ঝিনাইদহ শহরকে ‘নিরাপদ’ হিসেবে বেছে নেয় জঙ্গিরা। এ অঞ্চলের সাহসী ও উগ্র মনোভাবের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেদের জঙ্গি হিসেবে গড়ে তোলে। গত ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালুহাটী গ্রামের বেলেখাল বাজারে খ্রিস্টান হোমিও চিকিৎসক সমির বিশ্বাস ওরফে সমির খাজা ও ১৪ মার্চ কালীগঞ্জ শহরের নিমতলা এলাকার শিয়া মতবাদের হোমিও চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর ১ জুলাই ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাস্টসাগরা গ্রামে স্থানীয় রাধামদন মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে (৬২) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ পাঁচজনকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে জানান, পুলিশ ও র‌্যাবের কেউই তাদের আটক করেনি।

সর্বশেষ খবর