রবিবার, ১৭ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

জঙ্গিদের পক্ষে অনলাইনের ছড়াছড়ি

নাম ঠিকানা কিছুই নেই

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে নামসর্বস্ব ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম বা অনলাইন পোর্টাল। সংবাদের নীতি বা গুণগত মান তো দূরের কথা এসব অনলাইনের মালিক বা সম্পাদকের নাম পরিচয় বা ঠিকানাও নেই। কিন্তু এসব অনলাইনের নানান চটকদার শিরোনামের বিভ্রান্তিকর সংবাদের লিংকে ভরে যাচ্ছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এদের মধ্যে কয়েকটি সরাসরি জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডে সমর্থন ও উসকানিমূলক সংবাদ প্রকাশ করে মদদ দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদকে। সংবাদের নামে প্রচার করা হচ্ছে মিথ্যা তথ্য, ছড়ানো হচ্ছে গুজব। হয়রানি ও অবমাননার শিকার হচ্ছে নারীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। অথচ এগুলোর নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংস্থাগুলোর কোনো কার্যক্রম নেই। দৃশ্যমান তদারকিও নেই তথ্য মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি বা গোয়েন্দা সংস্থার। এ সুযোগে ইন্টারনেট হিটের জন্য বা উদ্দেশ্যমূলক বেপরোয়াভাবে সংবাদের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে বেশ কিছু অখ্যাত অনলাইন। সাংবাদিক নামধারী কিছু চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে পেশাদার গণমাধ্যম কর্মীদের। পাশাপাশি উদ্দেশ্য সাধন করছে জামায়াত-শিবিরের একটি অংশ। ইন্টারনেট ব্যবহার করে দেখা গেল, ফেসবুকে বহুবার শেয়ার হওয়া একটি অনলাইনের নাম বিডি-টুডে। ওয়েবসাইটটি ব্রাউজ করে দেখা গেল, এটি জঙ্গিবাদের প্রচারণার শীর্ষে। নাম বিডি-টুডে হলেও এর ওয়েব অ্যাড্রেস দেশ-বিডি ডট নেট (http://www.desh-bd.net)| আবার ফেসবুকের পেজ তাদের বিডিটুডে ডট নেট নামে। তাদের সাইটে কোনো ঠিকানা বা সম্পাদকের নামও লেখা নেই। জামায়াত-শিবির পরিচালিত বাঁশেরকেল্লার বিভিন্ন পেজ থেকে এই ওয়েবসাইটের লিংক শেয়ার দেওয়া হচ্ছে অহরহ। নামসর্বস্ব নিউজ পোর্টালটি বিভ্রান্তিমূলক সংবাদে ভরা। যেমন গত ২ জুলাই থেকে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে—‘ইন্ডিয়া বাংলাদেশে স্পেশাল ফোর্স পাঠাচ্ছে’। পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দনভাবে প্রচার করা হচ্ছে গুলশান হামলায় নিহত পুলিশ কর্মকর্তা ওসি সালাউদ্দিনের চাকরি জীবনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ। পূর্বের অভিযোগের কারণে ওসি সালাউদ্দিনকে হত্যা জায়েজ উল্লেখ করে মন্তব্যসহ ফেসবুকে শেয়ার দেওয়া হয়েছে লিংক। একইরকম সংবাদসমগ্র নামের (http:// www.songbadshomogro.com) আর একটি অনলাইন। সম্পাদকের নাম তো নেই, এমনকি এই সাইটে কোনো ঠিকানাও নেই। উসকানিমূলক সংবাদ প্রচারই তাদের প্রধান কাজ। আর জঙ্গিবাদের পক্ষে প্রচারণার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে নানা উসকানিমূলক সংবাদ প্রকাশ করে এ অনলাইন।

এ ছাড়া জঙ্গিবাদের নানা প্রচার-প্রচারণা করে তারা তরুণ প্রজন্মকে উসকে দিচ্ছে।

অন্যান্য অনলাইন সম্পর্কে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে দেখা গেল, মোহাম্মদপুরের একটি চায়ের দোকান থেকে চালানো হচ্ছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। পল্টনে এক দোকানে ১২-১৩টি অনলাইনও আছে। আর বাকিগুলো বেশিরভাগই পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে। কিন্তু ওয়েবসাইটে নেই কোনো ঠিকানা। আবার নাম দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোর নামের আদলে। জানা যায়, ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের দোকানের মাধ্যমে ৫-১০ হাজার টাকা খরচ করেই অনলাইন খোলা যাচ্ছে। যে কোনো একটি নামের শেষে ডটকম লাগিয়ে চালু করা হচ্ছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। অনেকে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে ওয়েবসাইটের নাম দিচ্ছে প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমের আদলে। যেমন আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ইন্ডিপেনডেন্ট২৪ টিভি, সময়নিউজ২৪ নামেও আছে ভুয়া গণমাধ্যম। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো তদারকি বা অনুমোদন প্রক্রিয়া না থাকায় যে কেউ খুলে বসছে এসব অনলাইন। উদ্দেশ্য সাধন শেষে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে ওয়েবসাইট।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মতে, ইন্টারনেটের যুগে ফেসবুক অথবা বিভিন্ন ব্লগ বা বিভিন্ন অনলাইন নিউজ-পোর্টালের মাধ্যমে খবর দ্রুত সবাইকে জানানো যেমন সহজ, তেমনি খবরের নামে বিভ্রান্তিও ছড়ানো যায় দ্রুতই। আর এসব সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গিবাদ প্রচার, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, বিতর্কিত সৃষ্টিসহ নানা উসকানিমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন ক্যাডার গ্রুপ। তারা নামে-বে-নামে অনলাইন নিউজ পোর্টাল করে জঙ্গিবাদের প্রচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নিউজ পোর্টাল ভিজিটর পাচ্ছে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজের মাধ্যমে। এমন সব খবর প্রকাশ করে যা দেখে অনেকেই কৌতূহলে এসব নিউজ-পোর্টাল ভিজিট করেন। জঙ্গিবাদের প্রচারণায় নামা এসব নিউজ পোর্টাল বিভিন্ন ব্যক্তি তথা নারীদের নাম ব্যবহার করে ফেসবুক পেজ খুলে জঙ্গিবাদের প্রচার চালাচ্ছে। অনেক সময় তারা বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি ব্যবহার করছে এসব পেজে। হাতে গোনা কয়েকটি অনলাইন নিউজ-পোর্টাল বাদে শত শত পোর্টাল আছে যারা কপি পেস্ট বা এমন সব খবর প্রকাশ করে যা জঙ্গিবাদে উৎসাহিত করে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি অথরিটির (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, প্রপাগান্ডা ছড়ানো বেনামি অনলাইন পত্রিকা বা পোর্টালগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি। দুভাবে এটি মোকাবিলা করা যায়। প্রথমত, যেসব অনলাইন এমন অপপ্রচার বা জঙ্গি তত্পরতাকে উৎসাহিত করে সংবাদ প্রকাশ করে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, এক্ষেত্রে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র‌্যাব, কিংবা গোয়েন্দা সংস্থা এসব অনলাইন সম্পর্কে বিটিআরসিকে অবহিত করলে তখনই সঙ্গে সঙ্গে বিটিআরসি ব্যবস্থা নেবে।

এ বিষয়ে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) লিগাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, অনলাইন শুধু নয়, বিভিন্ন মাধ্যমে জঙ্গি কর্মকাণ্ড সমর্থনমূলক যে কোনো তথ্য ছড়ানো বা গুজব ছড়িয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে অশান্ত করার মতো নানা কর্মকাণ্ডের ওপর মনিটরিং করা হয়। প্রমাণ মিললে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।

সর্বশেষ খবর