সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভাড়াটিয়া ভয়ঙ্কর

পরিচয় গোপন করে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে জঙ্গি আস্তানা, অস্ত্র গোলার ভান্ডার

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাড়াটিয়া ভয়ঙ্কর

সঠিক নাম-পরিচয় জানা ছাড়া বাসা ভাড়া নেওয়া ভাড়াটিয়ারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে এভাবে বাসা ভাড়া নিয়ে জঙ্গি আস্তানা গড়ে তোলার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে প্রায়শই। পরিচয়হীন বা ভিন্ন পরিচয়ে থাকা ভাড়াটিয়ারা গড়ে তুলছেন অস্ত্র ও গোলাবারুদের ভাণ্ডার। দেশে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত হওয়া জঙ্গি আস্তানা ও গোলাবারুদের ভাণ্ডারগুলোর প্রায় সবই ছিল ভাড়া বাসা। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই অপারেশন এলাকার আশপাশে সাময়িক সময়ের জন্য ভাড়া বাসায় আশ্রয় নেয় জঙ্গিরা। পরে অপারেশন শেষে আর ফেরে না সেই আস্তানায়। সর্বশেষ গুলশানের আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালানো জঙ্গিরাও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ছদ্মবেশে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। তাদের নাম-ঠিকানা ছাড়া বাসা ভাড়া দেওয়া বা স্থানীয় পুলিশকে ভাড়াটিয়ার তথ্য না দেওয়ায় ঢাকা ও ঝিনাইদহের তিন বাড়িওয়ালাকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল গ্রেফতার হয়েছেন মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাড়িওয়ালা নুরুল ইসলাম। আগের দিন শনিবার গ্রেফতার হয়েছেন ভাটারার বাড়িওয়ালা অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন। জানা যায়, গত বছরের ২৩ অক্টোবর ঢাকার হোসনি দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে হামলা ও এর আগের দিন ২২ অক্টোবর গাবতলীর আমিনবাজার চেকপোস্টে তল্লাশির সময় খুন হন এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা। এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা খুনের ঘটনাস্থলে গ্রেফতার মাসুদ রানার স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, পরপর দুই দিনের এই ঘটনায় ছিল একই গ্রুপ। তাদের মূল পরিকল্পনা ছিল হোসনি দালান ও মোহাম্মদপুরের তাজিয়া মিছিলে একই সময়ে হামলা। এ জন্য একসঙ্গে ১৩ জঙ্গি রাজধানীর

সন্নিকটে আশুলিয়ায় একটি বাড়ি ভাড়া নেয়। সেখানেই পরিকল্পনা ও ট্রেনিং শেষে মোহাম্মদপুরের বছিলায় দুটি বাসা ভাড়া নেওয়া হয়। এরপর সময় ঘনিয়ে এলে হোসনি দালানে বোমা হামলার জন্য কামরাঙ্গীরচরে একটি বাসা ভাড়া নেয়। বছিলা ও কামরাঙ্গীরচরের বাসায় অবস্থান করে জেএমবি সদস্যরা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু এই দুই ঘটনাই নয় সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহভাজনদের সবই ছিল ভাড়াটিয়া। তারা বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় বাড়ির মালিককে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল। বেশির ভাগই ছিল মেস। কেউ এক মাস অথবা কেউ ১০ দিন আগে ওই বাসাগুলোতে উঠেছিল। তারা ওইসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বা গোলাবারুদ রেখে সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জটিলতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এরপরই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়িওয়ালাদের তাদের ভাড়াটিয়াদের প্রত্যেকের নাম, পরিচয়, ঠিকানা ও ছবি স্থানীয় থানাকে সংগ্রহ করার নির্দেশ দেয়। কয়েক লাখ ভাড়াটিয়ার তথ্যও সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু জমা পড়েনি গুলশান হামলা ও শোলাকিয়ায় হামলা চালানো জঙ্গিদের বাসা ভাড়া নেওয়ার তথ্য। অথচ তারা সাতক্ষীরা ও ঢাকার তিনটি বাসায় ভাড়াটিয়া ছিলেন বলে মনে করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। জানা যায়, গুলশান হামলায় জড়িত চিহ্নিত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে অন্যতম নিবরাস ইসলাম ও শোলাকিয়া হামলায় নিহত জঙ্গি আবির রহমান দীর্ঘ সময় ছিলেন ঝিনাইদহ শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি ভাড়া বাসায়। সেই জঙ্গি আস্তানায় আরও ছয়জনের সঙ্গে থাকতেন নিরবাস ও আবির। নিবরাস নিজের নাম বলেছিলেন ‘সাঈদ’। আর আবিরকে পরিচয় দিত তার চাচাতো ভাই। মাস চারেক আগে ঝিনাইদহ সদর থানা থেকে সোনালীপাড়ায় সাবেক এক সেনাসদস্য কওছার আলীর বাড়িতে চার কক্ষের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেটাকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে তারা। স্থানীয় মসজিদের ইমাম ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোকনুজ্জামানের মাধ্যমে ২ হাজার ৩০০ টাকায় ঘরটি ভাড়া নেয় জঙ্গিরা। তারা নিজেদের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেয়। রোকনুজ্জামান সাঈদ (নিবরাস) ও মোস্তাফিজ (আসল নাম অজানা) নামের দুজনকে নিয়ে যায় ওই বাসায়। বলেছিলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র থাকবেন। কিছু দিন পর আরও ছয়জন থাকা শুরু করেন সেখানে। রমজানের শুরুতে ছয়জন বাড়ি যাওয়ার কথা বলে চলে যান। বাকি দুজন ২৮ জুন (গুলশান হামলার দুই দিন আগে) চলে যান। এরপর আর ফেরেননি কেউ। পরে গুলশান হামলার পর ৬ জুলাই ভোরে র‌্যাবের একটি দল ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বাড়ির মালিক সাবেক সেনা সদস্য কওছার আলী, তার কলেজপড়ুয়া দুই ছেলে বিনছার আলী (২২) ও বিনজির আলী (১৯) এবং বাড়ির পাশের মসজিদের ইমাম মো. রোকনুজ্জামান ও সহকারী ইমাম সাব্বির হোসেনকে আটক করে নিয়ে যায়। এ সময় তাদের ঘর তল্লাশি করে তার ছেলেদের একটি ল্যাপটপ ও কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক নিয়ে যায়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নিবরাসসহ অন্য জঙ্গিরা হামলার আগে এসে ঢাকায় আশ্রয় নেন আর্টিজান রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি ভাটারায় একটি ফ্ল্যাটে। ওই ফ্ল্যাট থেকে বালুভর্তি কার্টন, জঙ্গিদের কাপড়সহ বিভিন্ন মালামাল জব্দ করে পুলিশ। বালুভর্তি ওই কার্টনে হামলায় ব্যবহূত গ্রেনেড রাখা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। শনিবার বিকালে গ্রেফতার হন ভাটারার ফ্ল্যাটের মালিক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্য ও স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেসের ডিন গিয়াস উদ্দিন আহসান, গিয়াস উদ্দিনের ভাগনে আলম চৌধুরী এবং ওই ভবনের ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান তুহিন। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গিদের জন্য গত মে মাসে ফ্ল্যাটটি ভাড়া করেছিলেন তাদের সহযোগী সদস্যরা। কিন্তু ডিএমপির নির্দেশনা অনুযায়ী ভাড়াটিয়াদের নাম, ঠিকানা ও পরিচয়সহ নির্ধারিত ফরম পূরণ করে থানায় জমা দেওয়া হয়নি। একই অভিযোগে গতকাল গ্রেফতার হয়েছে জঙ্গিদের আরেকটি আস্তানা ঢাকার মিরপুরেরর শেওড়াপাড়ার বাড়ির মালিক নুরুল ইসলাম। ওই বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষে আস্তানা গড়েছিল চার জঙ্গি। তারা নিজেদের বাঙ্লা কলেজের ছাত্র পরিচয় দিয়ে ওই বাসা ভাড়া নিয়েছিল। সেখান থেকে হাতে তৈরি গ্রেনেড ও কালো পোশাক উদ্ধার করেছে পুলিশ। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, এসব বাড়ির মালিকদের সঙ্গে ভাড়াটিয়াদের কোনো যোগসাজশ ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ঝিনাইদহে মেস ভাড়া দিতে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে : ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এখন থেকে ঝিনাইদহে মেস ভাড়া দিতে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে। কারা মেসে থাকতে পারবে আর কারা থাকতে পারবে না সেটা পুলিশ যাচাই-বাছাই করবে। বর্তমানে কতগুলো মেস আছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই জেলা পুলিশের কাছে। তাই পুলিশ এ উদ্যোগ নিয়েছে। খুব শিগগিরই একটা সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে। কোন ধরনের মানুষ সেখানে থাকে সেটাও জানা যাবে বলে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ কর্মকর্তারা।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর বাড়িভাড়া নিয়ে অনেকটা নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ প্রশাসন। এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে শহরে মাইকিং করা হচ্ছে। ভাড়াটিয়াদের তথ্য থানায় জমা দেওয়া, একেবারে অপরিচিত কাউকে যেন বাড়ি ভাড়া দেওয়া না হয়— এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ফরমও বিতরণ করা হচ্ছে। বাড়ির মালিকদের ফরমটি পূরণ করে থানায় জমা দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোশারফ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ে একটি নির্দেশনা আগেও ছিল। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে এখন এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই বাসা বাড়ির মালিকদেরকে বিষয়টি মেনে চলা উচিত।

জিজ্ঞাসাবাদ : ঈদের দিন শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার এক সপ্তাহ আগে জঙ্গিরা শহরের নীলগঞ্জ সড়কের একটি বাসাভাড়া নিয়ে অবস্থান করছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এরই মধ্যে বাড়ির মালিক অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা আবদুস সাত্তারকে পুলিশ ও গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বাসার যে ইউনিটটি তারা ভাড়া নিয়েছিল, পুলিশ বাসার সে ইউনিটটি তালাবদ্ধ করে রেখেছে।

সর্বশেষ খবর