বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

জঙ্গিতে ধামাচাপা রাজনীতি

বিএনপিতে কমিটি গঠনের খবর নেই, আওয়ামী লীগের কাউন্সিল তত্পরতায় ধীরগতি

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

জঙ্গিতে ধামাচাপা রাজনীতি

চলমান জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ ইস্যুতে ধামাচাপা পড়ে গেছে দেশের রাজনীতি। পরপর দুটি ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলায় পুরো দেশে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সব সেক্টরেই পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। থমকে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতিও। স্বাভাবিক সভা-সমাবেশ কর্মসূচিও কমে গেছে। চার মাস আগে কাউন্সিল হলেও ঘোষণায় চাপা পড়ে গেছে বিএনপির নির্বাহী কমিটি। দলের নেই কোনো সাংগঠনিক তত্পরতা। একইভাবে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সরকার। দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও মনোযোগ নেই আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের। কাউন্সিল ঘোষণার পর নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল, এখন তাতে অনেকটাই ভাটা পড়েছে। কাউন্সিল প্রস্তুতিতে চলছে ধীরগতি। শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপিই নয়, অন্য দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও ঝিমিয়ে পড়েছে। জাতীয় পার্টি, গণফোরাম, বিকল্পধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাসদ, বাসদসহ অন্য দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। রাজনীতিতে আবার নতুন মাত্রা পেয়েছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যে। সোমবার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, ‘রাজনীতিতে নীরবতা রয়েছে। ভয় এখানেই। মনে রাখবেন, গাছের পাতা যখন নড়ে না, ঝড়ের ভয় ঠিক তখনই। আর এ কারণেই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।’ এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা আলোচনা। চায়ের কাপে ঝড় উঠছে তার এ বক্তব্যে।

আওয়ামী লীগ : জঙ্গিবাদ ইস্যুতে ভাটা পড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শুধু কাউন্সিলই নয়, সাংগঠনিক অন্যান্য কর্মকাণ্ডেও গতি নেই। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে তৃণমূলে কমিটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দলটি। এদিকে তৃতীয় দফায় পিছিয়ে আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে গঠিত বিভিন্ন উপ-কমিটি ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করলেও গত ১ জুলাই গুলশানের আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর আর কোনো সভা ডাকা হয়নি। আগামী আগস্টেও বৈঠক ডাকা হবে না। কারণ মাসব্যাপী শোকের সিরিজ কর্মসূচি পালন করবে দলটি। দলের শীর্ষ নেতারা এ মুহূর্তে সম্মেলন প্রস্তুতি নিয়ে তেমনটা ভাবছেন না। তারা বলছেন, এ মুহূর্তে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। সে লক্ষ্য নিয়েই তারা এখন মাঠে নামছেন। তবে দলের একটি সূত্র আভাস দিয়েছে, নির্ধারিত সময়ে সম্মেলন না হয়ে পরিবেশ-পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হলেই সম্মেলন করা হবে। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময় পিছিয়ে আগামী ডিসেম্বরে এ সম্মেলন হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।

দলীয় সূত্রমতে, কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সবাই এখন ব্যস্ত সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত গঠন করা নিয়ে। সম্মেলন নিয়ে এ মুহূর্তে আগ্রহ নেই কোনো কেন্দ্রীয় নেতার। এ কারণে তারা নিজেদের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো কথাবার্তা বলছেন না। যে কারণে কাউন্সিল প্রস্তুতিতে ভাটা দেখা যাচ্ছে। তবে দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, যথাসময়ে সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য আওয়ামী লীগ প্রস্তুত রয়েছে। প্রস্তুতির অনেকটা এগিয়েও রয়েছে। আর এক-দুবার বৈঠক করলেও কাউন্সিল সম্পন্ন করা যাবে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ এক সপ্তাহ সময় পেলেই সম্মেলন করতে প্রস্তুত। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সম্মেলন ভাটা পড়বে এমন নয়। আমরা যথাসময়েই সম্মেলনের কাজ শুরু করব। দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্মেলনের ব্যাপারে কার্যক্রম শুরু না হলেও ভাবার কোনো কারণ নেই, সম্মেলন পিছিয়ে যাবে। আগামী আগস্টেও আমাদের কর্মসূচি নেই। তবে সেপ্টেম্বরে সম্মেলনের পুরো প্রস্তুতি নেব। সময়মতো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের কাজ অনেক এগিয়ে রয়েছে। প্রতিটি উপকমিটি কমপক্ষে তিন-চারটি করে বৈঠক করেছে। দলীয় সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের সম্মেলন সফল করতে নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে ১১টি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব উপকমিটি কয়েক দফা বৈঠক করেছে। মঞ্চ ও সম্মেলনের প্রধান গেট ইতিমধ্যে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদনও করেছেন। জানা গেছে, ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলন হয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমান কার্যনির্বাহী সংসদের মেয়াদ গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে।

বিএনপি : একই ইস্যুতে চাপা পড়ে গেছে বিএনপির রাজনীতিও। দলে নেই কোনো সাংগঠনিক তত্পরতা। কাউন্সিলের চার মাস পার হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটির নেই কোনো খবর। কমিটি কবে হবে— কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না। সম্প্রতি দল সমর্থিত বুদ্ধিজীবীদের বৈঠকে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জানান, ‘এটা দলের বিষয়, আমি দেখছি। সময়মতো কমিটি দেব। অন্য কোনো বিষয়ে আপনারা কথা বলুন।’ পরে আর কেউই এ প্রসঙ্গে কোনো কথা তোলেননি। দলের নেতারাও খালেদা জিয়াকে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলছেন না। তবে দিন যতই যাচ্ছে, নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা ততই বাড়ছে। বিএনপির এক নেতা জানান, জঙ্গি ইস্যুটি সামনে চলে আসায় কমিটি অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। এ ইস্যু নিয়ে বেগম জিয়াও বিভিন্নজনের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। জাতীয় ঐক্যেরও ডাক দিয়েছেন তিনি। সরকার সাড়া না দেওয়ায় বিএনপি এখন আলাদা প্লাটফরম করার চিন্তাভাবনা করছে। গণফোরাম, বিকল্পধারা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ কয়েকটি বাম সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তবে তাদের নিয়েও কোনো ভরসা পাচ্ছে না দলটি।

অন্যদিকে ওই দলগুলোও জামায়াতের কারণে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। জোটের বাইরে সরকারবিরোধী অন্য দলগুলোকে নিয়ে তারা বিকল্প কিছু করার চিন্তাভাবনা করছে। বিএনপির একটি সূত্র জানায়, এবার হজে যাবেন খালেদা জিয়া। লন্ডন থেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সপরিবারে সৌদি আরব আসবেন। তাই কোরবানির ঈদের পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেন তিনি। অবশ্য এর আগে আরও এক ধাপ কমিটি দেওয়া হতে পারে। কমিটি নিয়ে তিনি কাজ করছেন। স্থায়ী কমিটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জটিলতায় পড়ছেন খালেদা জিয়া। এ পদে নতুন আগ্রহী আরও অন্তত ১৫ জন নেতা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে একটি দিলে শূন্যপদ থাকে চারটি। এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় বিএনপির হাইকমান্ড। তবে এ সিদ্ধান্তহীনতা মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় জেলা পর্যায়ে পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও থমকে আছে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কমিটি নিয়ে কাজ করছেন চেয়ারপারসন। কাউন্সিলররাই তাকে এ দায়িত্ব দিয়েছেন। এটা নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। সময়মতো চেয়ারপারসন কমিটি দেবেন। বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেমে গেছে, এটা বলা যাবে না। চলমান পরিস্থিতি বিএনপি পর্যবেক্ষণ করছে। চেয়ারপারসন দলের সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে কাজ করছেন। মহাসচিব দেশের বাইরে। তিনি ফিরলেই দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে। খুব শিগগিরই বিএনপির নির্বাহী কমিটি ঘোষণা হবে বলে আমরা আশা করছি। এদিকে গুলশানে জঙ্গি হামলার পর ৭৯ নম্বর সড়কে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়েও এখন নেতা-কর্মীদের আনাগোনা কমে গেছে। বিএনপি-প্রধানও নিয়মিত অফিস করছেন না।

মাঝেমধ্যে এলেও এখন আর দীর্ঘ রাত পর্যন্ত থাকছেন না। গুলশান এলাকা পুরোটাই এখন কড়া নিরাপত্তায়। তাই নেতা-কর্মীরা যেতে ভয় পাচ্ছেন। নয়াপল্টন কার্যালয়ও এখন অনেকটাই নীরব। গতকালও দুপুর পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের কোনো আনাগোনা দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যালয়ের প্রবেশদ্বারে অবস্থান করতে দেখা গেছে। অবশ্য বিকালে কার্যালয়ের নিচ তলায় মিলাদ মাহফিলে গুটিকয় নেতা-কর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

সর্বশেষ খবর