শিরোনাম
শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
হাসিনা-মোদির ভিডিও সংলাপ

জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের পাশে ভারত

বেনাপোল ও পেট্রাপোল বন্দরের ইন্ট্রিগ্রেটেড চেক পোস্ট উদ্বোধন

কূটনৈতিক ও নিজস্ব প্রতিবেদক

জঙ্গি দমনে বাংলাদেশের পাশে ভারত

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনের লড়াইয়ে বাংলাদেশ কখনই একা নয়, এ লড়াইয়ে সব সময় বাংলাদেশের পাশে ভারত থাকবে বলে জানিয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে  বলেন, ‘জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনি কখনো একা মনে করবেন না। আপনার পাশে পুরো ভারতের সমর্থন আছে। আমি আপনাকে আরও আশ্বাস দিতে চাই যে, জঙ্গি দমনে আপনি যে লড়াই করছেন ভারত আপনার সঙ্গে আছে।’ গতকাল বেনাপোল ও পেট্রাপোল বন্দরের সমন্বিত ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট ঢাকা ও দিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যৌথভাবে উদ্বোধনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ ভিডিও কনফারেন্সে পশ্চিমঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও কলকাতা থেকে যোগ দেন।

অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদি  বলেন, ‘এটা ঈদের মাস। বাংলাদেশে বসবাসকারী সব ভাই-বোনকে আমার ও সব ভারতবাসীর তরফে পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা জানাই। এটা আমার ও সব ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, রমজান মাসেই ঢাকা ও কিশোরগঞ্জে জঙ্গি হামলা হয়েছে। সেখানকার মন্দিরে, সেবায়েতের ওপর, সাধারণ মানুষের ওপর জঙ্গিরা বর্বরতম অত্যাচার চালিয়েছে। আমরা এ জঙ্গি হামলার তীব্র নিন্দা করছি। হতাহত সবার পরিবারের প্রতি ভারতবাসীর সমবেদনা রয়েছে। আজকের দুঃসময়ে পুরো ভারত বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই নেতৃত্বের জন্য শেখ হাসিনাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। আপনার নেতৃত্ব জঙ্গিবাদে জড়িতদের প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা।’

শেখ হাসিনার উদ্দেশে মোদি বলেন, ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে আপনি কখনই নিজেকে একা ভাববেন না, আপনার প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও জানাতে চাই, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারত সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখন একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছি, এটা শুধু বর্তমানের সঙ্গে নয়, ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমরা সব সময়ই মনে করি, ভারতের উন্নতি তার প্রত্যেক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর ভারত-বাংলাদেশ শুধু উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্পর্কযুক্ত তা নয় বরং ভারত-বাংলাদেশ সব বিষয়েই পাশাপাশি চলছে।’ এর আগে বাংলায় ভাষণ শুরু করে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আদান-প্রদান আরও সহজ হবে। আমরা আরও কাছাকাছি এলাম।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, ‘আমি মনে করি এই পেট্রাপোল-বেনাপোল স্থলবন্দরের আধুনিকীকরণের ফলে দুই দেশের আর্থিক ব্যবস্থা আরও মজবুত হবে তাই নয়, আমাদের দুই দেশের মানুষে মানুষে যোগাযোগও বৃদ্ধি পাবে।’ এ ভিডিও কনফারেন্সে উপস্থিত থাকার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও অভিনন্দন জানান মোদি। একই সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে মমতার উল্লেখযোগ্য ভূমিকারও প্রশংসা করেন তিনি। এ সময় মোদির পাশেই ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, স্বরাষ্ট্র সচিব রাজীব মেহর্ষি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশ দুই বন্ধুপ্রতিম দেশ। আমাদের দেশের জনগণের স্বার্থে এ যোগাযোগটা প্রয়োজন ছিল। কথায় আছে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী, বাণিজ্য যত বাড়বে দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার তত উন্নতি হবে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু দুই দেশের নয়, আঞ্চলিক যোগাযোগ আমরা স্থাপন করেছি। মিয়ানমার, ভারত, বাংলাদেশ, চীনের মধ্যে এই যোগাযোগের ফলে এ অঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে এবং আমাদের দুই দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি আরও মজবুত হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।’ তিনি বলেন, বেনাপোল ও পেট্রাপোল চেকপোস্ট চালু হওয়ার মাধ্যমে আগামীতে বাংলাদেশ-ভারত আরও গভীর সম্পর্কের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে মজবুত ভিত্তি রচনা করবে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সড়ক-রেল চালু হয়েছে। সার্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা আরও এগিয়ে যাব। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালের কথা সব সময় মনে করি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে অবদান সে কথা আমরা সব সময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সব সময় সুন্দর থাকবে, সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকবে এবং যে কোনো সমস্যা হলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে আমরা তার সমাধান করতে পারব, যা অতীতেও আমরা করেছি। সেভাবেই আমরা দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চাই।’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে অভিনন্দন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য। বিশেষ করে আমরা নিকটবর্তী প্রতিবেশী, আমাদের মধ্যকার সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক সব সময় অব্যাহত থাকবে।’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নিয়ে বলেন, ‘চেকপোস্টের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা নতুন সীমানা উন্মোচিত হলো। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সম্পর্ক আরও উন্নত হবে। যদিও দুই বাংলার মধ্যকার সম্পর্ক চিরদিনের। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তার মতোই বহমান।’ তিনি তার বক্তব্যে আরও বলেন, পশ্চিম বাংলা সব সময় বাংলাদেশকে ভালোবাসে। ভিডিও কনফারেন্সের বাংলাদেশ প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা প্রমুখ এবং ভারতের প্রান্তে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ উপস্থিত ছিলেন। ভিডিও কনফারেন্সের আগে বেনাপোল ও পেট্রাপোল চেকপোস্টের ওপর নির্মিত একটি ছোট্ট তথ্যচিত্র দেখানো হয়। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন জানিয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৭০-৮০ ভাগ হয় পেট্রোপোল-বেনাপোলের মাধ্যমে, এর পরিমাণ বার্ষিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এ বন্দর দিয়ে বছরে ১০ লাখের বেশি মানুষ ও দেড় লাখ ট্রাক পারাপার হয়। আগরতলা-আখাউড়া স্থলসীমান্তের পর দ্বিতীয় হিসেবে বেনাপোল-পেট্রাপোলে সমন্বিত চেকপোস্টের উদ্বোধন করা হলো। এরপর মেঘালয়ের ডাউকিতে এ ধরনের চেকপোস্ট স্থাপন করা হবে। এর মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি হবে। লাভবান হবে স্থানীয়রা। বাড়বে বাংলাদেশ ও ভারতের কানেকটিভিটি।

বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, ভারত অংশে বেনাপোল বন্দরের গা ঘেঁষে ৩০০ হেক্টর জমির ওপর নির্মিত হয় অত্যাধুনিক এই ‘ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট’। পরে বেনাপোল বন্দরের সঙ্গে লিঙ্ক রোড তৈরি করে সংযোগ দেওয়া হয় পেট্রাপোল বন্দরের ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টের। জানা গেছে, ভারতের এই ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টটির প্রধান নিরাপত্তা দায়িত্বে রয়েছে দুই শতাধিক ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ সদস্য। এক হাজার পণ্যবাহী ট্রাকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে আরও গতিশীলতা আনবে। ট্রাক টার্মিনাল, এয়ারকন্ডিশন ওয়্যারহাউস, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট জোন, স্ক্যানিং মেশিনসহ বিশ্বের আধুনিক বন্দরের সব সুযোগ-সুবিধা থাকছে এখানে।

গতকাল উদ্বোধনের মূল ভিডিও কনফারেন্সের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বেনাপোল বন্দরের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে ভিডিও কনফারেন্স করেন বেনাপোল ও যশোরের সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা। এজন্য বেনাপোল আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ও ওপারে পেট্রাপোল বন্দরে পৃথক ভিডিও কনফারেন্সর আয়োজন করে উভয় দেশের বন্দর কর্তৃপক্ষ। ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট ছাড়াও বেনাপোল বন্দরের লিঙ্ক রোড, বাস টার্মিনালসহ আরও কয়েকটি স্থাপনা উদ্বোধন করা হয়।

সর্বশেষ খবর