সাত পাকে বাঁধা পড়ার মতোই ঘুরপাক খাচ্ছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাহী কমিটি হচ্ছে, হবে করতে করতে এরই মধ্যে চলে গেছে চার মাস। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এখন বলা হচ্ছে, কমিটি দিয়েই হজে যাবেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই কমিটি হতে পারে বলেও কেউ কেউ আভাস দিয়েছেন। তবে কমিটি ঘোষণায় দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ নেতা-কর্মীরা। দিন যতই যাচ্ছে, হতাশা ততই বাড়ছে। কমিটি বিলম্বিত হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে জানা যায়, শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতা। শুধু কমিটিই নয়, দলীয় রাজনীতি ও আন্দোলন কর্মসূচির ক্ষেত্রেও এটা কাজ করছে। ঢাকা-লন্ডনের মতবিরোধের পাশাপাশি স্থায়ী কমিটিতে কে যাবে কে থাকবে, তা নিয়েও নানা হিসাব-নিকাশেও বিলম্বিত হচ্ছে কমিটি। ‘এক নেতার এক পদ’ বাস্তবায়নে জেলা ও কেন্দ্রের নেতৃত্বে সমন্বয় করতে গিয়েও ঘাম ঝরছে নীতিনির্ধারকদের। কমিটিতে পদবঞ্চিতদের বিদ্রোহের শঙ্কাও মাথায় রাখা হচ্ছে। আবার পদ পাওয়ার পর কেউ কেউ বেইমানি করে কিনা তাও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে সিনিয়র একাধিক নেতা বলেছেন, সব বাধা পেরিয়ে এখন কমিটি চূড়ান্ত করে ফেলেছেন চেয়ারপারসন। যে কোনো দিন কমিটি ঘোষণা করা হবে। দলের কমিটির আকার কত সদস্যের হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। নেতারা এ নিয়ে মুখ খুলছেন না। এবারই প্রথম বিষয়ভিত্তিক কমিটি হচ্ছে। অবশ্য কয়েক দিন ধরে কমিটি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন খালেদা জিয়া। তবে কমিটির রূপরেখা কোনো নেতাই বলতে পারছেন না। সম্প্রতি দলের নেতাদের বিএনপি প্রধান বলেছেন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম দেশে ফিরলেই কমিটি দেবেন। এরই মধ্যে লন্ডন সফর শেষে দেশে ফিরেছেন ফখরুল। চলতি সপ্তাহের যে কোনো দিনই কমিটি হয়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কমিটি গঠনের কাজ চূড়ান্ত করেছেন চেয়ারপারসন। যে কোনো দিন কমিটি ঘোষণা করতে পারেন তিনি। দলের কাউন্সিলররা কমিটির ব্যাপারে চেয়ারপারসনকেই দায়িত্ব দিয়েছেন। গত চার মাসে তিন ধাপে মাত্র ৪২ সদস্যের নাম ঘোষণা হয়েছে। এই আংশিক কমিটি নিয়েও নেতা-কর্মীদের প্রশ্নের শেষ নেই। কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশই অযোগ্যরা ঠাঁই পেয়েছেন বলে অভিযোগ তাদের। যদিও প্রকাশ্যে কেউই এ নিয়ে মন্তব্য করছেন না। তবে দিন যতই যাচ্ছে, বিএনপির সর্বত্রই হতাশা বাড়ছে। এ কারণেই এবার দেখেশুনে কমিটির কাজ করছেন বেগম জিয়া। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও মতামত নেওয়া হচ্ছে। এর আগের ধাপগুলোতে কমিটি নিয়ে ঢাকা-লন্ডনে মতদ্বৈততা ছিল। এবার কমিটিতে নেতাদের মতামতকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন বেগম জিয়া। জানা যায়, আগস্টের শেষ দিকে কিংবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরব যেতে পারেন খালেদা জিয়া। লন্ডন থেকে সপরিবারে তারেক রহমানও আসতে পারেন। এর আগেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া গুছিয়ে ফেলার চিন্তা তার। কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলে তাও মিটিয়ে হজে যাবেন তিনি। এ ছাড়া জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ার আগেই দলের কমিটি ঘোষণা দেবেন খালেদা জিয়া। একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে শূন্য রয়েছে মাত্র তিনটি পদ। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান পদাধিকার বলে স্থায়ী কমিটির সদস্য। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে থাকছেন। বর্তমান কমিটির অন্য ১৪ জনও থাকছেন নতুন কমিটিতে। বাকি দুই পদে অন্তত দেড় ডজন নেতা পদ প্রত্যাশী।
এ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন বেগম জিয়া। তিনি এরই মধ্যে কয়েকজন নেতার নাম স্থায়ী কমিটিতে রাখার ব্যাপারে বলেছেনও। কিন্তু এখন কাকে রেখে কাকে বাদ দেবেন, তা নিয়েই চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। কোনো নেতা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বলেছেন, স্থায়ী কমিটিতে জায়গা না হলে তারা রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন। এ বিষয়টিও চেয়ারপারসনের কানে গেছে। জানা যায়, সার্বিক হিসাব-নিকাশ করেই এরই মধ্যে স্থায়ী কমিটি নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন খালেদা জিয়া। বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, দলের দফতর শাখা ও ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক পদ নিয়েও কিছুটা বিপদে পড়েছেন বেগম জিয়া। দলের দফতর সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী এখন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। এখনো তিনি দফতর দেখভাল করতে আগ্রহী। অন্যদিকে আরও কয়েকজন নেতার নজর এখন দফতরে। অবশ্য দলের দুর্দিনে রিজভী আহমেদই দফতর বিভাগ শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। বিএনপি চেয়ারপারসনও তার প্রতি ইতিবাচক। আবার এক নেতার এক পদ বাস্তবায়ন করতে গেলে নতুন করে ভাবতেও পারেন বেগম জিয়া। এদিকে ছাত্রবিষয়ক ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদকের পদ নিয়েও বেশ কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা দৌড়ঝাঁপ করছেন। এ নিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও বিভক্ত মত দিয়েছেন। এ পদ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘কমিটি নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তার বিষয় আছে। সবচেয়ে বৃহৎ দলের কমিটি হুটহাট করে দেওয়া যাবে না। এতে হিতে বিপরীতও হতে পারে। এ নিয়ে ভেবেচিন্তে চেয়ারপারসন কাজ করছেন। আশা করি, শিগগিরই কমিটি ঘোষণা করা হবে। কমিটি হলেই নেতা-কর্মীদের মধ্যে ফের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। এ নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়।’ বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, ‘বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হয়েছে। এরই মধ্যে আংশিক কমিটিও হয়েছে। বাকিগুলোও হবে, এ নিয়ে টেনশনের কোনো কারণ নেই। কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কাজ করছেন। আশা করছি, শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হবে।’