শিরোনাম
বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

পুলিশের গুলিতে নিহত ৯ জঙ্গি

কল্যাণপুরে মেসে ব্যাপক গোলাগুলি, পুলিশের দাবি ওরা গুলশান হামলাকারী গ্রুপের

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুলিশের গুলিতে নিহত ৯ জঙ্গি

জঙ্গিদের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স। ছয়তলা বাড়িতে আস্তানা গড়ে তোলে জঙ্গিরা। উদ্ধার করা অস্ত্র —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের বিশেষ অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়েছে। সোমবার দিবাগত মধ্য রাত থেকে গতকাল ভোর পর্যন্ত ‘অপারেশন স্ট্রম-২৬’ নামের এই অভিযানের পর ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসান নামের এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কল্যাণপুর মেইন রোড থেকে ৫ নম্বর রোডের ৫৩/৫ নম্বর তাজ মঞ্জিল নামের ছয়তলা ভবনের পাঁচতলায় জঙ্গিরা সাতটি কক্ষে বসবাস করে আসছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। অভিযান শেষে ওই আস্তানা থেকে চারটি পিস্তল, ২৫ রাউন্ড গুলি এবং ২৩টি হ্যান্ডগ্রেনেড, ৫ কেজি বিস্ফোরক ও বিপুল পরিমাণ উসকানিমূলক ধর্মীয় বই উদ্ধার করেছে পুলিশ। বিকাল ৪টার দিকে ৯ জঙ্গির লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। অন্যদিকে, ভাড়াটিয়া সম্পর্কে তথ্য গোপন করার অপরাধে বাড়ির মালিকের স্ত্রী ও তার ছেলেকে আটক করেছে পুলিশ। জানা গেছে, র‌্যাব-পুলিশের অন্তত এক হাজার সদস্য অংশ নেন অভিযানে। নেতৃত্বে থাকে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষায়িত দল সোয়াত। সোমবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে ভবন ও তার আশপাশের এলাকা ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। মঙ্গলবার ভোর ৫টা ৫১ মিনিটে এই অভিযান শুরু হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা যায়। রোজার ঈদের পর ওই ভবনে ১১ যুবক অবস্থান করছিল। এর আগে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওই ভবনের পাঁচতলার ফ্ল্যাটে ঢোকার চেষ্টা করে পুলিশ। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে দেশীয় হ্যান্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করে জঙ্গিরা। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভোর ৫টার দিকে অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল।

সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ সময় সেখানে উপস্থিত সংবাদ কর্মীদের এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘কল্যাণপুরের নিহত জঙ্গিরা জেএমবির সদস্য। তারা নিজেদের আইএস বলে। আমরা বলি জেএমবি। তারা গুলশান হামলার জঙ্গিদের মতোই কালো পোশাক পরা ছিল। তাদের মাথায় ছিল পাগড়ি। তারা বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছিল।’ নিহতরা গুলশান-শোলাকিয়ায় হামলাকারী গ্রুপের সদস্য। আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, গুলশানের ঘটনায় নিহত জঙ্গি এবং কল্যাণপুরের জঙ্গিরা একই গ্রুপের সদস্য। তবে আমরা বড় ধরনের নাশকতার আগেই তাদের নিবৃত্ত করতে পেরেছি। তিনি দাবি করেন, এটি ইতিহাসের সফলতম অভিযান। সরেজমিন গত সোমবার মধ্যরাত থেকে কল্যাণপুরের সেই জঙ্গি আস্তানার আশপাশে অবস্থান করে দেখা যায়, অভিযান উপলক্ষে বাড়িটি পুলিশ প্রহরায় রাখা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ফরেনসিক বিভাগের লোকজন ও পুলিশ বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পরই ঘটনাস্থলে আসেন পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মারুফ হাসানসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের জন্য পুলিশের তোলা ছবিতে মেঝেতে পড়ে থাকা জঙ্গিদের গায়ে কালো পোশাক দেখা গেছে। একাধিক কর্মকর্তার মুঠোফোনে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, নিহতদের কারও কারও মাথায় ছিল রুমাল। ছবিতে ঘরের ভিতর ও সিঁড়িতে কয়েকটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তাদের পরণে ছিল কালো পাঞ্জাবি ও জিন্স প্যান্ট। মেঝেতে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ঘরের ভিতর আসবাবপত্র বিশেষ কিছু নেই। একটি প্লাস্টিকের তাক রয়েছে তাতে কিছু বই ও অস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে তোশক, বালিশ ও চাদর। আসবাবপত্র না থাকলেও বাসায় ১০-১২টি ব্যাগ ও ব্যাগপ্যাক রয়েছে।

যেভাবে অপারেশনের সূত্রপাত : সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মিরপুর থানা পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মিলে কল্যাণপুরের মেস বাসায় জঙ্গিবিরোধী তল্লাশি শুরু করেন। কল্যাণপুরের ৬ নম্বর রোড থেকে তল্লাশি শুরু হয়। কয়েকটি মেসে অভিযান চালিয়ে তারা ৫ নম্বর রোডে আসেন। এই রোডে জাহাজ বিল্ডিং খ্যাত ৫ নম্বর বাসায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। পুলিশ তিনতলায় পৌঁছার পরই তাদের ওপর জঙ্গিরা বোমা হামলা শুরু করে। বিয়ষটি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করার পর তারা উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসেন। বৈঠকে বিশেষায়িত দল সোয়াত টিমকে দিয়ে অপারেশন স্ট্রম-২৬ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয় তাদের সঙ্গে থাকবে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও থানা পুলিশ। কিছু সময়ের মধ্যেই জাহাজ বিল্ডিংয়ের আশপাশের ভবনের ছাদে সশস্ত্র অবস্থান নেয় পুলিশের সদস্যরা। ভোর ৫টা ৫১ মিনিটে শুরু হওয়া অপারেশনের সমাপ্তি হয় ৬টা ৫১ মিনিটে। এ সময় জঙ্গি এবং পুলিশের গোলাগুলিতে আশপাশের এলাকা কেঁপে ওঠে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকার মানুষের মধ্যে।

আল্লাহু আকবর দিয়ে প্রতিরোধ : জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শুরু করলে জঙ্গিরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে পুলিশকে প্রতিহত করা শুরু করে। তারা পুলিশের ওপর গুলি ও হাতবোমা নিক্ষেপ করে। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে এক জঙ্গি গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে আহতাবস্থায় আটক করে পুলিশ। অভিযান চালানোর পরে ওই ভবন থেকে পুলিশের ওপর একটি হ্যান্ডগ্রেনেডও নিক্ষেপ করা হয়। এতে একজন পুলিশ সদস্য আহত হন।

‘তাজ মঞ্জিল’ ওরফে ‘জাহাজ বিল্ডিং’: কল্যাণপুরের ৫ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাড়িটির নাম ‘তাজ মঞ্জিল’ হলেও জাহাজ বিল্ডিং নামেই বেশি পরিচিত। ছয়তলা এই ভবনের দোতলায় থাকেন বাড়ির মালিক যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আতাহার উদ্দিন আহমেদের পরিবার। তিনতলায় ফ্যামিলি ভাড়া দেওয়া। চার ও পাঁচতলা এবং ছয়তলায় মেস। ভবনটির প্রতিটি তলায় চারটি করে ইউনিট রয়েছে। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মমিনের দাবি, গত ১২ জুলাই ভবনটির পাঁচতলা ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা। তবে কয়েক দফায় বলার পরও ওই যুবকরা ভাড়াটিয়া ফরম পূরণ করে দেয়নি। দুপুরের দিকে ‘জাহাজ বিল্ডিং’-এর মালিকের স্ত্রী মমতাজ পারভীন ও তার ছেলে মাজহারুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদ আহমদ বলেন, ভাড়াটিয়াদের সম্পর্কে তথ্য না নেওয়া ও পুলিশের কাছে তথ্য গোপন রাখার কারণে ৫৪ ধারায় এই দুজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, বাড়ির মালিক আতাহার উদ্দিন আহমেদ প্রবাসী।

৯ জনের নাম বলল জঙ্গি হাসান : কল্যাণপুরের ওই বাড়িতে থাকা ১১ জঙ্গির মধ্যে ৯ জঙ্গির নাম জানা গেছে। তারা হলো— রবিন, সাব্বির, তাপস, অভি, আতিক, সোহান, ইমরান, ইকবাল ও হাসান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জঙ্গি মো. হাসান তাদের পরিচয় জানিয়েছে। হাসানের বাম পায়ের ঊরুতে এবং মাথার এক পাশে গুলি লেগে বেরিয়ে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসক। অন্যদিকে, জাহাজ বিল্ডিং থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৩ নারী ও দুই শিশুসহ ৪২ জনকে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। এদের মধ্যে গণমাধ্যম কর্মী আল্লামা ইকবাল অনিকের বাড়ি কুড়িগ্রামে। আশিক শ্যামলী পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। শাহাবুলের বাড়ি দিনাজপুর। তিনি সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কামরুল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। তিনি মিরপুরের একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এদের মধ্যে বাড়ির মালিকের ছেলে অ্যাডভোকেট জুয়েল ঈদের আগে দেশে ফিরে আসেন। তিনি আমেরিকান-বাংলাদেশি।

লাশ আস্তানা থেকে ঢামেক মর্গে : জঙ্গি আস্তানা থেকে নিহত জঙ্গিদের লাশ সরানো হয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় লাশ সরানোর কাজ শুরু হয়। মোট ৪টি অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয় লাশ সরানোর জন্য। লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নেওয়া হয়। প্রথম অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হয় চারটি মরদেহ। দ্বিতীয় অ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হয় দুটি লাশ। তৃতীয় অ্যাম্বুলেন্সে তিনটি মরদেহ। মোট ৯টি লাশ ঢামেকে নেওয়া হয়। 

তিন সদস্যের মেডিকেল টিম : ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, নিহত ৯ জঙ্গির ময়নাতদন্ত আজ সকাল ১০টার মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। তবে প্রাথমিকভাবে তাদের শরীরে গুলি ও বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। আর এ জন্য তিন সদস্যের একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের অন্য দুই সদস্যরা হলেন— ডা. প্রদ্বীপ বিশ্বাস ও ডা. কবির সোহেল।

নিহত জঙ্গিদের নাম-ঠিকানা জানতে চায় পুলিশ : রাজধানীর কল্যাণপুরে নিহত ৯ জঙ্গির ছবি প্রকাশ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। নিহত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্যও জানতে চেয়েছে পুলিশ। ডিএমপির ফেসবুক পেজে গতকাল সন্ধ্যায় এই ৯ জনের ছবি প্রকাশ করা হয়। এরপর বলা হয়, ‘ঢাকা মহানগর পুলিশ জঙ্গি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে আপনার সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করছে। আজ রাজধানীর কল্যাণপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময়কালে নিহত জঙ্গি/সন্ত্রাসীদের পূর্ণাঙ্গ নাম ও ঠিকানা জানা থাকলে এই পেজের ইনবক্সে প্রদান করুন। অথবা ই-মেইল করুন cyberunit¦dmp.gov.bd 

সর্বশেষ খবর