বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

পরিচয় মিলেছে সাত জঙ্গির গুলি পেছন থেকে

বিশেষ প্রতিনিধি

পরিচয় মিলেছে সাত জঙ্গির গুলি পেছন থেকে

রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত ৯ জঙ্গির মধ্যে সাতজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাজাদ রউফ অর্ক ওরফে মরক্কো, নোয়াখালী সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জোবায়ের হোসেন (২০), ধানমন্ডির তাজ-উল-হক রাশিক, গুলশানের আকিফুজ্জামান খান,  দিনাজপুরের আবদুল্লাহ, পটুয়াখালীর আবু হাকিম নাইম ও সাতক্ষীরার মতিয়ার রহমান। এদিকে এই অভিযান শেষ হওয়ার দুই দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। গতকাল রাতে যোগাযোগ করা হলে মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ভূইয়া মাহবুব হাসান জানান, মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গতকাল এক অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সংবাদ কর্মীদের বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে নিহতদের ছবি প্রকাশের পর আমরা সাড়া পাচ্ছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে নাম আসছে। আমরা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে তা প্রকাশ করলে প্রশ্ন উঠবে। তবে দুই-একজনের নাম আমরা অনেকটাই নিশ্চিত। এদিকে ৯ জঙ্গির লাশের ময়নাতদন্ত গতকাল শেষ হয়েছে। নমুনা সংগ্রহ শেষে কেমিক্যাল অ্যানালাইসিসের জন্য পরে তা সিআইডি ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া আলোচিত সেই জাহাজ বাড়ির মালিক মমতাজ পারভীনকে দুই দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন এ আদেশ দেন। পরিচয় মিলেছে : জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত যে তিন জঙ্গির পরিচয় মিলেছে তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী ছিল। এই তিন জঙ্গির মধ্যে সাজাত রউফ অর্ক ওরফে মরক্কো নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র ছিল। গুলশান হামলায় নিহত জঙ্গি নিবরাসের বন্ধু অর্ক। তার বাবার নাম তৌহিদ রউফ। ভাটারা এলাকায় তার পরিবারের বাস। নিহত অপর জঙ্গির নাম জোবায়ের হোসেন (২০)। সে নোয়াখালী সরকারি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। তার বাবার নাম আবদুল কাইয়ুম। তিনি নোয়াখালীতে আল-আমিন বিস্কুট কারখানার ভ্যানচালক। দুই মাস আগে জোবায়ের বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। এ ব্যাপারে নোয়াখালী সুধারাম থানায় গত ২৫ মে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।

এ ছাড়াও আরও যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলো— ধানমন্ডির ১১/এ নম্বর রোডের ৭২ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা রবিউল হকের ছেলে তাজ-উল-হক রাশিক, গুলশান ১০ নম্বর রোডের ২৫ নম্বর বাড়ির সাইফুজ্জামান খানের ছেলে আকিফুজ্জামান খান, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ থানার ভল্লবপুর গ্রামের সোহরাব আলীর ছেলে আবদুল্লাহ, পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার কুয়াকাটা গ্রামের নূরুল ইসলামের ছেলে আবু হাকিম নাইম, সাতক্ষীরার তালা থানার ওমরপুর গ্রামের নাসিরউদ্দিন সরদারের ছেলে মতিয়ার রহমান। বিভিন্ন মাধ্যমে ছবি প্রকাশের পর নিহত এক জঙ্গিকে নিজের সন্তান সাব্বিরুল হক বলে দাবি করেন চট্টগ্রামের আজিজুল হক। একই ছবি দেখে নিজের ছেলে জোবায়ের বলে দাবি করেন আরেক বাবা আবদুল কাইয়ুম। ঢাকা মহানগর পুলিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে লাশটি জোবায়ের বলে শনাক্ত করে। আমাদের নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, কল্যাণপুরে নিহত ৯ জঙ্গির মধ্যে মো. জোবায়ের হোসেনের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার পশ্চিম মাইজদী গ্রামের আবদুল্লাহ মেম্বারের বাড়ি। মো. আবদুল কাইয়ুমের বড় ছেলে জোবায়ের র‌্যাবের তালিকাভুক্ত নিখোঁজের একজন। সে নোয়াখালী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। নিহত ৯ জঙ্গির ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর আবদুল কাইয়ুম তার ছেলে জোবায়েরকে শনাক্ত করে গতকাল সকালে সুধারাম থানা পুলিশকে ঘটনাটি অবহিত করেন এবং ঢাকা থেকে ছেলের লাশ আনার ব্যাপারে পুলিশের সহযোগিতা চান। তিনি জানান, তার ছেলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মী ছিল। তাকে জঙ্গি হতে সক্রিয়ভাবে প্রলুব্ধ করেছে একই বাড়ির জামায়াতের রোকন মো. বাহাদুর। গত ১০ রমজান সে নিখোঁজ হয়। এ বিষয়ে ১২ জুলাই সুধারাম থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম জানান, জঙ্গি সন্দেহে আটকের জন্য পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে জোবায়েরকে খুঁজছিল।

গুলি লেগেছে যেখানে : গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ৯ জঙ্গির লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী অজ্ঞাত লাশের তালিকা অনুসারে নিহত জঙ্গিদের ময়নাতদন্ত শেষ করা হয়। এর পরই বিকাল সোয়া ৬টায় সেগুলোর নমুনা কেমিক্যাল অ্যানালাইসিসের জন্য সিআইডিতে ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্তের জন্য গতকাল বেলা ১১টা ৫ মিনিটে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট এসে পৌঁছায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। এরপর বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদের নেতৃত্বে ১২ জনের একটি মেডিকেল টিম ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রবেশ করে।

ময়নাতদন্ত শেষে বেলা ১টা ৩৭ মিনিটে মর্গ থেকে বেরিয়ে এসে ডা. সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, ৯টি লাশের মধ্যে চারজনের শরীর থেকে ৭টি বুলেট উদ্ধার করা হয়েছে। প্রত্যেকটি লাশের মধ্যেই ৫-৬টি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। আর অধিকাংশ লাশের পেছন দিক থেকে গুলি করার চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে সব লাশের সামনে-পেছনে, পেট, পিঠ, মাথা, মুখ, হাত ও পায়ে গুলির চিহ্ন। ৯ জনের মধ্যে একজনের শরীর থেকে তিনটি, আরেকজনের শরীর থেকে দুটি আরও দুজনের শরীর থেকে একটি করে দুটি বুলেট উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি পাঁচটি লাশের শরীরের একদিকে বুলেট ঢুকে আরেকদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এই বুলেটকে হেভি বুলেট বলা হয়।

ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, লাশগুলোর পরনে কালো পাঞ্জাবি, শার্ট, জিন্স, মোবাইল প্যান্ট এবং কেডস ছিল। মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টায় লাশগুলো মর্গে আনা হয়। তার প্রায় ১২ ঘণ্টা আগে ওই ৯ সন্ত্রাসী বা জঙ্গির মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, লাশগুলোর ময়নাতদন্ত থেকে সংগৃহীত নমুনার কিছু অংশ চেয়ে পাঠিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। আর কিছু নমুনা আমাদের কেমিক্যাল অ্যানাইলাইসিসের জন্য সিআইডিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিএনএ এবং কাউন্টার টেররিজমের জন্য চুল, রক্ত ও ইউরিনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আর কেমিক্যাল অ্যানালাইসিসের জন্য ভিসেরা, থাই, মাসল, রক্ত, স্টোমার, লিভার ও কিডনি সংগ্রহ করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের পরপরই লাশগুলো মর্গে ফ্রিজিং করে রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ময়নাতদন্তে থাকা ফরেনসিক বিভাগের অন্যরা হলেন— ডা. ইফফাত ফারুকী, ডা. জাকির, ডা. সায়েম, ডা. নাহিদ ফাতেমা, ডা. প্রিন্স চৌধুরী, ডা. সারজিল, ডা. ইকবাল, ডা. মাসুদ ও ডা. রাহাত।

এরপর বিকাল সাড়ে ৩টায় র‌্যাবের তালিকায় নিখোঁজ থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি সাজাদ রউফ অর্কের বাবা ও ভাই আমেরিকান দূতাবাসের এম ক-৪৬৪ নম্বরের একটি গাড়িতে করে আমেরিকার তৃতীয় কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে মর্গে লাশ শনাক্ত করতে আসেন। এ সময় তাদের সঙ্গে ময়নাতদন্তকারী মেডিকেল টিমের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদও ছিলেন। এ বিষয়ে ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, অর্কের পরিবারের সদস্যরা পুলিশের সরবরাহ করা ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করতে এসেছিল। তারা সুরতহাল রিপোর্টের অজ্ঞাত-৯ নম্বর লাশটিকে অর্ক বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। তবে ডিএনএ পরীক্ষার পর চূড়ান্ত করে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

মর্গ থেকে যাওয়ার সময় আমেরিকান দূতাবাসের তৃতীয় কাউন্সিলর দ্রুত লাশ হস্তান্তরের অনুরোধ করেন। এ সময় ডা. সোহেল মাহমুদ তাকে জানিয়েছেন, আমি আমার দেশকে ছোট করতে পারব না। যথাযথ প্রক্রিয়া এবং অনুমোদন সাপেক্ষে আমি লাশ হস্তান্তর করব।

ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য : জঙ্গি আস্তানায় নিহতদের মধ্যে কয়েকজনের পরিচয় জানতে পেরেছে পুলিশ। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে এখনই সেসব তথ্য প্রকাশ করতে রাজি হননি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। গতকাল ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জঙ্গি দমন বিষয়ে বাংলাদেশ বেতার আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কয়েকজনের পরিচয় জানতে পেরেছি। তবে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে এ বিষয়ে আমি বলতে চাই না। আদালত প্রতিবেদক জানান, কল্যাণপুরের আলোচিত সেই জাহাজ বাড়ির মালিক মমতাজ পারভীনকে দুই দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন এ আদেশ দেন। এর আগে মিরপুর মডেল থানার এসআই বজলার রহমান আসামি মমতাজ পারভীনকে আদালতে হাজির করে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন।

রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, পুলিশকে না জানিয়ে থানায় কোনো তথ্য না দিয়ে আসামি মমতাজ পারভীন জঙ্গিদের বাড়ি ভাড়া দেন। এ বিষয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি একেক সময় একেক কথা বলেন। তাই রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।

গত সোমবার রাত থেকে শুরু করে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত কল্যাণপুরের একটি বাসায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই অভিযানে ৯ জন নিহত ও একজন আহত হন। আহত রাকিবুল হাসান গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হয়ে পুলিশ প্রহরায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৭ নম্বর কেবিনে চিকিৎসাধীন। পুলিশ বলছে, তারা সবাই জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সদস্য।

সর্বশেষ খবর