বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

সেই জাহাজ বাড়ির কত কাহিনী

আলী আজম

সেই জাহাজ বাড়ির কত কাহিনী

রাজধানীর কল্যাণপুরে আলোচিত সেই জাহাজ বাড়ির প্রকৃত নাম তাজ মঞ্জিল। ভবনের ছাদ জাহাজের আদলে করার কারণে এলাকাবাসী ভবনটিকে জাহাজ বাড়ি নামেই ডাকে। জাহাজ বাড়ি নামে পরিচিত এ ভবনেই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সেখানে জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের গুলিবিনিময় হয়। এতে নয় জঙ্গি নিহতসহ হাসান নামে একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হয়। পুলিশ বলছে, নিহতরা সবাই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য। কল্যাণপুর প্রধান সড়ক ধরে কিছু দূর হাঁটলে ডান পাশে ৫ নম্বর সড়ক। এই সড়কের মাঝামাঝি অবস্থানে ছয়তলার একটি বিশাল ভবন। এর প্রধান ফটকে বাড়িটির নাম লেখা ‘তাজ মঞ্জিল’। এই তাজ মঞ্জিল বেশ জীর্ণ এবং বাড়িটিকে ঘিরে এলাকাবাসীর রয়েছে নানা রকম অভিযোগ। আশির দশকে নির্মাণ করা বাড়িটির প্রতিটি তলায় রয়েছে লম্বা বারান্দা। বাড়িটি এলাকাবাসীর কাছে ‘জাহাজ বিল্ডিং’ বা ‘জাহাজ বাড়ি’ নামে পরিচিত, যার মালিক সাবেক শুল্ক কর্মকর্তা আতাহার উদ্দিন আহমেদ। ছয়তলা বাড়ির প্রতিটি তলায় রয়েছে চারটি করে ইউনিট। দ্বিতীয় তলায় মালিকের ছেলে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। এই বাড়ির অন্য তলার বিভিন্ন ইউনিটে মেস করে ভাড়া থাকতেন ব্যাচেলররা। প্রতি ইউনিটের ভাড়া সাত হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। ওই বাড়ির তৃতীয় তলার ভাড়াটে রহিমা বেগম বলেন, ওই বাড়ির গ্যাস ও পানির-সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারা বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। রাতে স্বামী ভ্যানচালক সাহেব আলী এবং তাদের এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে একটি ফার্নিচার দোকানে রাত কাটান। পুলিশ তাদের বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। স্থানীয় এক মেসের বাসিন্দা বলেন, এই বাড়িতে রয়েছে নানা রকম অব্যবস্থাপনা। ভবনে ছোট ছোট খুপড়ি করে একটি কক্ষের ভেতর একাধিক কক্ষ বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়। সিঁড়িগুলো সরু। আলো-বাতাস ঢোকে না। নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল। অনেকটা নিরুপায় হয়েই লোকজন এখানে বাসা ভাড়া নিত। এখানে বেশি দিন কেউ থাকত না। ফলে সারা বছর বাড়ি ভাড়ার নোটিশ ঝোলানো থাকে। তাই প্রতিনিয়ত অচেনা মানুষের আনাগোনা থাকত। এলাকাবাসী বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, বিশেষ করে পুলিশ বেশ কয়েকবার এই বাড়িতে অভিযান চালায়। বছর খানেক আগে, মিরপুর মডেল থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন খানের নেতৃত্বে এই বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে নাশকতার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ ছাড়া এই বাড়িতে মাদকসহ নানা অসামাজিক কার্যকলাপের জন্য পুলিশ মাঝেমধ্যেই অভিযান চালিয়ে থাকে। গতকাল দেখা গেছে, জাহাজ বাড়িটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে পুলিশ। বাড়ির ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। জাহাজ বাড়ির প্রবেশ পথ এবং আশপাশে পুলিশের শক্ত অবস্থান। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না জানিয়ে কর্তব্যরত এক পুলিশ সদস্য বলেন, বাড়ির ভেতরে কেউ নেই। ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে চাইলে থানা থেকে অনুমতি লাগবে। অভিযানের দিনই ওই বাড়ির বাসিন্দারা সবাই চলে গেছে। তবে ভেতরে ভাড়াটিয়াদের জিনিসপত্র রয়েছে। ঘটনার পর থেকেই জাহাজ বাড়ির আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভয়ে শিশুরা বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। ওই এলাকার বাসিন্দা শামীম আল হাসান বলেন, তিনি পরিবার নিয়ে চারতলায় থাকেন। সারা রাত গুলি আর বোমার শব্দে তারা আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। তার তিন সন্তানকে ফ্লোরে শুইয়ে রাখেন। ওই রাতের ঘটনা বর্ণনা করার মতো না। তার সন্তানদের আতঙ্ক কাটেনি। ভয়ে তারা কেউ স্কুলে যায়নি।

জাহাজ বাড়ির পঞ্চম তলা বরাবর অপর একটি বাড়ির বাসিন্দা মালিহা হক প্রমি বলেন, জঙ্গিরা বারান্দায় এসে আল্লাহ আকবর বলে স্লোগান দিতে থাকে। বলে আমরা শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে বলে তোদের ছেলেও আমাদের পথে আসবে। আমাদের সঙ্গে আল্লাহ আছেন। মা ও বোনদের বলছি আমরা আল্লাহর পথেই শহীদ হচ্ছি।

প্রমি আরও বলেন, পুলিশ এবং জঙ্গিদের মধ্যে রাত ৩টা পর্যন্ত গুলিবিনিময় হয়। এরপর শান্ত। প্রমির মা-বাবাসহ দুই ভাই, মামী ও তিন শিশু বাসায় ছিল। তাদের মধ্যে জুলিয়ার আড়াই বছরের মেয়ে জয়িতা ভয়ে কাঁদতে থাকে। সারা রাত সে ঘুমায়নি। তারা সবাই আতঙ্কিত ছিলেন। ফজরের আজানের পর জঙ্গিরা বারান্দায় এসে আল্লাহু আকবর বলে স্লোগান দিতে থাকে। পরে ভোর সাড়ে ৫টা থেকে পুলিশ ও জঙ্গিদের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। এরপর জঙ্গিদের আর কোনো আওয়াজ শোনা যায়নি। ওই এলাকার বাসিন্দা পারুল আহমেদ তার চার বছর বয়সী সন্তান মুনিয়াকে নিয়ে এসেছেন জঙ্গি আস্তানার ওই বাড়িটি দেখানোর জন্য। পারুল বলেন, রাতে গুলির শব্দে তার মেয়ে ভয় পেয়েছে। তাই ভয় কাটাতে তিনি মেয়েকে এই বাড়িটি দেখাতে নিয়ে এসেছেন। ভবনের পাশে শিশু কল্যাণ কেজি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল আগামী শনিবার পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

গতকাল পুলিশ বাড়িটি সিলগালা করে দিয়েছে। পুলিশের অনুমতি ছাড়া ওই বাড়ি থেকে কোনো বাসিন্দা জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে পারবে না। গত মঙ্গলবার জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর আটক ৪২ জনের মধ্যে ৩৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। আটক চারজনের মধ্যে বাড়ির মালিক আতাহার উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী মমতাজ বেগমকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। মিরপুর থানার ওসি ভূইয়া মাহবুব হাসান বলেন, এ ঘটনায় বাড়ির মালিকের স্ত্রী মমতাজ বেগম ছাড়াও চারজন আটক রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বাকি ৩৮ জনকে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নয় জঙ্গি নিহতের ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পাঁচতলা বাড়িটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। অনুমতি ছাড়া ওই ভবনের জিনিসপত্র কেউ সরাতে পারবে না। বাসায় কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অনুমতি নিয়েই বাসায় প্রবেশ করতে হবে। পুলিশের এই সিদ্ধান্তের ফলে জাহাজ বাড়িতে বসবাসকারী অন্তত ৩০টি পরিবার বিপাকে পড়েছেন। পুলিশের এই সিদ্ধান্তে ভাড়াটিয়ারা বলছেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযানের বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশকে সহায়তা করা প্রয়োজন। তারা এখন ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতে চাইছেন না। পুলিশের অনুমতি নিয়ে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে যেতে চান। এ ক্ষেত্রে তাদের স্কুল-কলেজগামী সন্তানরা বিপদে পড়েছে। আশপাশের আত্মীয়স্বজনের বাসায় সাময়িকভাবে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। পুলিশের মিরপুর বিভাগের ডিসি মাসুদ আহাম্মদ বলেন, তথ্য গোপন করার অভিযোগে বাড়ির মালিকের ছেলেসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। ভবনের অন্য বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা ইচ্ছা করলে ওই বাড়িতে যেতে পারবেন। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই বাড়িতে কেউ ঢুকতে পারেনি। ভবনের সামনে দায়িত্বে থাকা মিরপুর থানার এসআই মনির হোসেন জানান, ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই ভবনে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর কল্যাণপুরে ৫ নম্বর রোডের ৫৩ নম্বর জাহাজ বাড়ির পঞ্চম তলার জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের ঘণ্টাব্যাপী চালানো ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’-এ ৯ জঙ্গি নিহত হয়।

সর্বশেষ খবর