শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

মামলার ভারে বিএনপি

তারেকের সাত, খোকার ১৩ বছর সাজা, খালেদা জিয়াকে নিয়েও চিন্তায় নেতা-কর্মীরা

মাহমুদ আজহার

মামলার ভারে বিএনপি

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী ঢাকাসহ সারা দেশে দলের ৭ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার মামলার খড়্গ ঝুলছে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে সিনিয়র সব নেতাই এখন কাঠগড়ার আসামি। ওয়ান-ইলেভেনের দুর্নীতি মামলাও সমানতালে সচল হচ্ছে। এরই মধ্যে নিম্ন আদালতে খালাস পাওয়া অর্থ পাচারের এক মামলায় উচ্চ আদালতে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৭ বছরের সাজা হয়েছে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দলের আরেক ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার সাজা হয়েছে ১৩ বছর। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরেরও মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। সাজা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনেরও।

বিএনপির নীতিনির্ধারকদের শঙ্কা, বেগম খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র সব নেতাকেই এ পদ্ধতিতে সরকার নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ করে সংসদ নির্বাচন দিতে পারে। সেটা আগামও হতে পারে, আবার নির্ধারিত মেয়াদ শেষেও হতে পারে। তবে আগামীতে সংসদ নির্বাচন যখনই হোক— অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার নিশ্চয়তা পেলে তাতে অংশ নেবে বিএনপি। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে হলেও নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে দলটির নেতা-কর্মীর বড় একটি অংশ। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে বিকল্প কোনো পথও খোলা নেই বলে মনে করেন নেতাদের কেউ কেউ।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের নির্বাচনের বাইরে রাখার চেষ্টা করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে মামলাগুলো তড়িঘড়ি করে শেষ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে তারেক রহমানকে এক মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। চেয়ারপারসনের মামলাগুলোও দ্রুত গতিতে শেষ করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের এ পরিকল্পনা কখনই বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। সিনিয়র নেতাদের অযোগ্য করে নির্বাচন দিলে তাতে বিএনপি অংশ নেবে কিনা— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। এখনই এ নিয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার প্রক্রিয়াও অনেক দূর এগিয়েছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যেই এ মামলার রায় হতে পারে। নেতা-কর্মীদের শঙ্কা, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, খালেদা জিয়ারও সাজা হতে পারে। দলের আইনজীবীরা বলছেন, ‘সাজা’ হলে খালেদা জিয়াকেও আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। পরে জামিন চেয়ে আপিল করতে হবে। সরকার হার্ডলাইনে থাকলে তাকেও জেলের ঘানি টানতে হবে।

এদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনেকটাই ‘অনিশ্চিত’। অর্থ পাচার মামলায় সাজা নিয়ে এ সরকারের আমলে তার সশরীরে উপস্থিত হয়ে আপিল করার সম্ভাবনাও কম। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করলে সংবিধানসম্মতভাবেই আগামী সাত বছর সব ধরনের নির্বাচনে অযোগ্য হবেন তিনি। আরেক ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকারও দেশে ফিরে আপিল করার সম্ভাবনা খুবই কম। এমনিতেই শারীরিকভাবে অসুস্থ খোকা। তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, সরকারের এ মেয়াদে খোকার দেশে ফেরার ইচ্ছা নেই। লুত্ফুজ্জামান বাবরেরও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

বিএনপি নেতাদের আশঙ্কা, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ‘সাজা’ কার্যকর হলে দলের ঐক্য ধরে রাখাই কঠিন হবে। দলের সুবিধাবাদীরা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচনে অংশও নিতে পারেন। শীর্ষ দুই নেতাকে বাইরে রেখে ‘আগাম’ নির্বাচনও দিতে পারে সরকার। সরকারের মদদে বিএনপি নাম নিয়ে একটি অংশের সেই নির্বাচনে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এখনই সেই ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে এবার বিএনপিতে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন, ভবিষ্যতে তাদের দলে ঠাঁই হবে না বলেও মনে করেন বিএনপির ওই নেতা। ত্যাগী নেতাদের মতে, অতীতে অনেককেই চেয়ারপারসন ক্ষমা করে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে খালেদা জিয়া চাইলেও ত্যাগী নেতা-কর্মীরা তাদের ক্ষমা করবেন না।

বিএনপির আইনজীবীরা বলছেন, নাইকো ও গ্যাটকো দুর্নীতি মামলাসহ ২৭টি মামলার আসামি বেগম জিয়া। সব মামলার বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততার সঙ্গে চলছে। একইভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ছাড়াও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশত মামলা রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে দুর্নীতি। তার বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা দুটি মামলা চলছে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ। এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণও শেষ পর্যায়ে। যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষিত হবে। বেশ কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া জানান, ‘জিয়া পরিবারসহ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সাজা দিতে সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। এরই মধ্যে এক মামলায় তারেক রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলায়ও আমরা ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা করছি। সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের নির্বাচন এবং রাজনীতি থেকে দূরে রাখার অপচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।’

শুধু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানই নন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, জমিরউদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বরচন্দ্র রায়সহ দলের সিনিয়র নেতারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলার আসামি। এ ছাড়াও কারও কারও বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের দুর্নীতির মামলাও সচল আছে। এই নেতাদের মামলাও দ্রততার সঙ্গে এগিয়ে চলছে।

জানা যায়, এ পরিস্থিতিতে দলের ভবিষ্যৎ চিন্তা মাথায় রেখেই কমিটি করছেন বেগম জিয়া। আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করতে পারেন তিনি। সে ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেতাদের সামনে রেখেই কমিটি দিচ্ছেন বিএনপিপ্রধান। এরই মধ্যে ৪২ সদস্যের কমিটি ঘোষিত হয়েছে। যদিও ঘোষিত কমিটির কয়েকজন নেতার ভূমিকা নিয়ে দলের ভিতরই প্রশ্ন উঠেছে। এদিকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও মহানগর ও অঙ্গসংগঠনের কমিটি দিয়েই পবিত্র হজব্রত পালন করতে সৌদি আরব যাবেন খালেদা জিয়া। লন্ডন থেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সপরিবার হজে যেতে পারেন বলে সূত্র জানায়।

সর্বশেষ খবর