সোমবার, ১ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
আইনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা

ঢাকা রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে চলছে কেরানির শাসন

নিজস্ব প্রতিবেদক

আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার ভাতিজা হওয়ার সুবাদে এক কেরানিকে নিয়ে ঢাকা রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে চলছে নজিরবিহীন অনিয়ম। নতুন চাকরি পাওয়া এই কেরানিকে (অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর) সুবিধা দিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে।

খন্দকার মো. তুহিন নামে সেই কেরানি এক বছরের মধ্যেই নগরীর ডেমরা এবং বাড্ডা সাব-রেজিস্ট্রির মতো  লোভনীয় কর্মস্থলে পোস্টিং পেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, তিনি মো. হানিফ নামে একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে অকালীন বদলির মাধ্যমে ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বাড্ডা অফিসে পোস্টিং পেয়েছেন। অথচ সেখানে তার চাকরি সময়সীমা আরও এক বছর রয়েছে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, এই কেরানিকে খুশি করতে কৌশলে বাড্ডা রেজিস্ট্রি অফিসের অধিক্ষেত্র (সীমানা) পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এটা আইন মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি নজিরবিহীন ঘটনা বলে একাধিক সাব-রেজিস্ট্রার এবং দলিল লেখক জানান। এর ফলে ওই অফিসে দলিল রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা এবং হয়রানির মতো নানা ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে রেজিস্ট্রি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে আসা লোকজনকে। তাদের মতে, আইনমন্ত্রীর অগোচরেই হয়তো এটি করা হয়েছে। বাংলাদেশ নকলনবিস অ্যাসোসিয়েশন থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, একজন নকলনবিস ২০-২৫ বছর চাকরি করে মোহরার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তারপর কেরানি তথা অফিস সহকারী হয়ে থাকেন। কারণ রেজিস্ট্রি অফিসে কেরানি হতে হলে সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। বিষয়টি নিবন্ধন ম্যানুয়েলের ষষ্ঠ খণ্ডের ৩০৭ এর ‘গ’ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ায় আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে খন্দকার মো. তুহিনকে সরাসরি রেজিস্ট্রি অফিসের কেরানি হিসেবে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। অথচ এক্ষেত্রে তার এক দিনের অভিজ্ঞতাও ছিল না। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের নির্দেশে ঢাকা নগরীতে তিনটি নতুন সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সৃষ্টি করা হয়েছে মূলত জনগণের হয়রানি লাঘব করতে। এর ফলে নগরীর ১০টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের অধিক্ষেত্র নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে। ঠিক তখনই ইচ্ছাকৃতভাবে বাড্ডা অফিসের সঙ্গে ভাটারা এবং খিলক্ষেত থানা এলাকা যুক্ত করে দেওয়া হয়। এর ফলে বাড্ডা অফিসটি আগের চেয়ে আরও বেশি ব্যস্ত অফিসে পরিণত হয়েছে। আইনমন্ত্রী যে উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকায় নতুন সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সৃষ্টি করেছেন এর ফলে সে উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ভাটারা এলাকার ভূমি মালিক শওকত আলী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাব-রেজিস্ট্রার জানান, কোথাও নতুন সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সৃষ্টি করা হলে তার জন্য প্রথমে সেই এলাকার সাধারণ মানুষদের মধ্যে গণশুনানির মাধ্যমে মতামত নিতে হয়। এর মাধ্যমে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়। কিন্তু নতুন অফিসের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং নিবন্ধন পরিদফতর মিলে তাদের খেয়াল-খুশি মতো রেজিস্ট্রি অফিসের অধিক্ষেত্র বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে উল্লিখিত কেরানিকে বিশেষ সুবিধা দিতেই বাড্ডা অফিসকে অসমভাবে বড় করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ভাটারা থানাধীন একাধিক বাসিন্দা আইন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওয়াজউদ্দিন ও হাবিবুর রাহমান প্রমুখ স্বাক্ষরিত সেই অভিযোগপত্রে জানা যায়, এলাকাবাসীর কোনো মতামত ছাড়াই ভাটারা থানাকে গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে কেটে বাড্ডা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন দলিল রেজিস্ট্রি করতে অধিক সময় ব্যয় হবে, অন্যদিকে ভূমিসংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে আদালতের কার্যক্রমে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হবে। আগে ভূমিসংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমায় গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিসকে বিবাদী করা হয়েছে। এখন থানা পরিবর্তন হলে সেসব মামলা নিষ্পত্তি হতে বাদী-বিবাদী দুই পক্ষকেই ঝামেলা মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশ দলিল লেখক সমিতির একাধিক নেতা জানান, একটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মব্যস্ততা নির্ণয় হয় সে অফিসে দৈনিক কতটি দলিল রেজিস্ট্রি হয় তার ওপর নির্ভর করে। সে হিসাবে শুধু ঢাকা নয়, দেশের অন্যতম ব্যস্ত রেজিস্ট্রি অফিস হলো বাড্ডা। অথচ সে অফিসের সঙ্গে নতুন করে দুটি থানা যুক্ত করার বিষয়টি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অচিরেই ওই ব্যস্ত অফিস থেকে কিছু মৌজা বা থানা কম ব্যস্ত অফিসভুক্ত করা উচিত। অথচ ঢাকার সবচেয়ে কম ব্যস্ত সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রাপুর থেকে বেশ কয়েকটি মৌজা অন্য অফিসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে সূত্রাপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসটি বাস্তবিক কর্মহীন হয়ে পড়বে। একই অবস্থা হয়েছে তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ক্ষেত্রে। ওই অফিসের আওতাধীন ধানমন্ডি এলাকা নিয়ে নতুন সাব-রেজিস্ট্রি অফিস হওয়ায় ওই অফিসে দলিল রেজিস্ট্রির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। একই কারণে ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত সাব-রেজিস্ট্রি অফিস উত্তরা ছোট হয়ে গেছে। তুরাগ থানার বেশ কয়েকটি মৌজা নতুন সাব-রেজিস্ট্রি অফিস পল্লবীতে যুক্ত করার কারণে উত্তরা অর্ধেক হয়ে গেছে। তাই বিভিন্ন এলাকার ভূমি মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, গণশুনানির মাধ্যমে নতুন করে অধিক্ষেত্র তৈরি করা হোক। দলিলের সংখ্যার ভিত্তিতে অফিসের সীমানা তৈরি করা হলেই জনগণ ভালো সেবা পাবেন। তা না হলে হয়রানি, দুর্ভোগ আর  ঘুষপ্রীতি আরও বেড়ে যাবে। নতুন অধিক্ষেত্র কীভাবে হয়েছে সেটা সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার এবং জেলা রেজিস্ট্রার কেউই জ্ঞাত নন বলে জানা গেছে। মূলত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খেয়াল-খুশি মতো হয়েছে নতুন করে সীমানা তৈরির কাজ। যার কারণে এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার মো. আবদুল জলিল জানান, তিনি নির্দেশ পালন করছেন মাত্র। উপরের নির্দেশে অধিক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। সে মতে প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। বর্তমানে নতুন তিনটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস অবকাঠামো তথা চেয়ারটেবিল ও এজলাস তৈরির কাজ চলছে। যদি অফিসের অধিক্ষেত্র করার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক কিছু হয়ে থাকে তবে সেটা পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা সম্ভব। কারণ জনস্বার্থে নতুন অফিস করা হয়েছে। সেখানে জনস্বার্থ রক্ষিত না হলে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া দোষের কিছু নয়।

সর্বশেষ খবর