মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

নতুন চ্যালেঞ্জে দেশ

জুলকার নাইন

নতুন চ্যালেঞ্জে দেশ

ক্ষুদ্র পাহাড়ি রাষ্ট্র ভুটান। বাংলাদেশের সঙ্গে আছে সুসম্পর্ক। শান্তিপ্রিয় হিসেবে পরিচিত ভুটানে মাত্র তিন দেশের নাগরিকদের ভিসার কোনো শর্ত নেই। বাংলাদেশ এর একটি। আর সাধারণ ভুটানিরা বাংলাদেশিদের পছন্দও করে অনেক বেশি। কিন্তু সেই ভুটানে এখন বাংলাদেশিদের জন্য গ্যারান্টার (নিশ্চয়তা প্রদানকারী) চাইছে। গ্যারান্টার ছাড়া বাংলাদেশিদের এখন ভুটানের মতো দেশেও বেড়াতে যেতে সন্দেহ করা হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারত তার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। দার্জিলিং শিলিগুড়ি, কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশি বৈধ পর্যটকদের হোটেলকক্ষও ভাড়া দেওয়া হচ্ছে না। স্থানীয় পুলিশের সতর্কতা ও বাড়তি হয়রানির ভয়ে হোটেল মালিকরা সাধারণ বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ সিঙ্গাপুরে। পরপর দুটি ঘটনায় সিঙ্গাপুরে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বাংলাদেশের। শঙ্কায় ফেলেছে সেখানে প্রায় দেড় লাখ প্রবাসী বাংলাদেশিকে। কারণ সিঙ্গাপুরে সবাই খুবই শান্তিপ্রিয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাউকে কটাক্ষ করার কোনো সুযোগ নেই। এমন পরিবেশে বসেই বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্র করছিল, এমন অভিযোগে সিঙ্গাপুরে দুই দফায় ৪০ জন উগ্রপন্থি বাংলাদেশি আটক হয়েছে। তোলপাড় করা এই খবরে নেতিবাচক মনোভাব তৈরির শঙ্কা বাংলাদেশি কমিউনিটির। শঙ্কিত বাংলাদেশ সরকারও। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনারও প্রবাসীদের সতর্ক করেছেন একাধিক দফায়। শঙ্কা তৈরি হচ্ছে মালয়েশিয়াতেও। একের পর এক চিহ্নিত তরুণ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা করাকালীন জঙ্গি হয়েছেন বলে তথ্য বেরিয়ে আসছে। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে তদন্তের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে মালয়েশিয়ার গোয়েন্দারা। এখন শঙ্কিত সেখানে থাকা বড় সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। বাংলাদেশে পরপর হামলার শিকার হয়ে জাপানি ও ইতালীয় নিহত হওয়ার ঘটনায় এই দুটি দেশেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ইতিমধ্যেই ইতালিতে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের ওপর আলাদা নজরদারি শুরু হয়েছে। গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই বাংলাদেশি অধ্যুষিত মসজিদগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আনাগোনা বেড়েছে। রাস্তায় রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশিদের ডকুমেন্ট চেক করছে। কমিউনিটির পক্ষ থেকেও বাংলাদেশিদের সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। জাপানে বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে নানান ধরনের ব্যাখ্যা চাইছে দীর্ঘ পরিচিত জাপানিরা। হঠাৎ করেই বিশ্ব দরবারে নতুন এক ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। গুলশান হামলা দেশকে ফেলে দিয়েছে এই নতুন চ্যালেঞ্জে। জঙ্গিবাদী আক্রমণের ঘটনা বিদেশে বাংলাদেশকে ফেলেছে ইমেজ সংকটে। সন্ত্রস্ত করেছে বাংলাদেশের নানান কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ দায়িত্বে থাকা বিদেশিদের। উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলো তাদের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায়। সংশয়ে আছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও। প্রতিশ্রুতি দিয়েও এখন বিনিয়োগের বিষয়ে ভাবার সময় নিচ্ছে বিদেশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো। এমন অবস্থায় দেশের নতুন প্রজন্মের মাঝে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগ্রহ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অবশ্য বিদেশে গিয়েও পড়তে হচ্ছে সংকটে। কারণ গুলশান হামলার পর বিশ্বের নানান দেশের বিমানবন্দরেও বাড়তি তল্লাশিতে হয়রানি হতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। দুবাই ও সিঙ্গাপুরের মতো ট্রানজিট পোর্টগুলোতে আলাদা করে দীর্ঘ সময় তল্লাশি ও কাগজপত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে বাংলাদেশিদের। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে প্রবেশেও একই ধরনের পরীক্ষা ও সতর্কতার মুখে পড়তে হচ্ছে। ভিসার ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে এক বাংলাদেশি তরুণের মালয়েশিয়ার পর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে শিক্ষাগ্রহণকালে সিরিয়া যাওয়ার পথে তুরস্কে গিয়ে ধরা পড়ে যায় মার্কিন গোয়েন্দাদের তথ্যে। যুক্তরাষ্ট্র ওই গোয়েন্দা তথ্য অস্ট্রেলিয়াকে জানায়, পরে অস্ট্রেলিয়া তুরস্কের সহায়তায় ওই তরুণকে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়। এ ঘটনা মেধাবী হিসেবে পরিচিত শিক্ষার্থীদেরকেও নতুন করে নজরদারিতে এনেছে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। প্রভাব পড়েছে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহায়তায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অংশীদার জাইকা তার প্রতিশ্রুত ২৯ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পে সিদ্ধান্ত নিতে হঠাৎ করেই সময় চেয়েছে। এর আগে জাপানের কর্মী ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। চাওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। ফেরত পাঠানো হয়েছে কমগুরুত্বপূর্ণ কাজে থাকা জাপানিদের। আর যারা থাকছেন তারা অফিসের বাইরে যাচ্ছেন না বললেই চলে। এটা শুধু জাপানিদের ক্ষেত্রে নয়, বাংলাদেশে থাকা সব বিদেশিই শঙ্কিত হয়ে নিজেদের চলাফেরা কমিয়ে দিয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে বিদেশি কর্মকর্তারা দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন। ছুটিতে যাওয়ার নামে তারা ঢাকা ত্যাগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে ছুটির বিষয়ে অনুমতির জন্য সরকারের সম্মতি চাওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশের নাগরিকরাও গভীর উদ্বেগের মধ্যে কাজ করছেন বলে তাদের দূত জানিয়েছেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করেছে। জাতিসংঘের দফতরগুলো মাঝে মধ্যেই তাদের কর্মীদের ঐচ্ছিক ছুটি দিচ্ছে। কেউ বাসায় বসে কাজ করতে চাইলে সে অনুমতিও দিচ্ছে। এ ছাড়া ইতালি ও জার্মানির নাগরিকদের অনেকেই ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। তাদের কেউ কেউ না ফেরার সম্ভাবনা আছে। জার্মানি রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন তার দূতাবাসের দুই কর্মী আর ফিরবেন না। সেই সঙ্গে না ফেরার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন জার্মান রাষ্ট্রদূত। বায়ারদের ঢাকা সফর স্থগিতের সংখ্যা বেড়ে গার্মেন্ট খাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় আছেন ব্যবসায়ীরা। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ইতিমধ্যেই ঢাকা থেকে সরে গেছে দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ভেন্যু। বাতিল করা হয়েছে জাপানে বাংলাদেশবিষয়ক সেমিনার। দুই সপ্তাহ পরে অনুষ্ঠিতব্য দি এশিয়া প্যাসিফিক মানিলন্ডারিং গ্রুপ (এপিজিএমএল) ও সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফরমেশন সেন্টারের (এপনিক) সম্মেলন। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে অক্টোবরের সম্মেলনও। মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারক ও টেলিকম প্রযুক্তি সরবরাহকারী চায়নিজ কোম্পানি হুয়াওয়েসহ কয়েকটি কোম্পানি তাদের কর্মীদের প্রয়োজনে দেশের বাইরে থেকে অফিসের কাজ করার জন্য বলেছে। গত ঈদের পরপরই জাপানের এনইসির ঢাকায় আসার কথা ছিল একটি স্মার্ট সিটির কাজ নিয়ে। তাদের সফর এখন বাতিল। পশ্চিমা একটি দেশে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে থাকা এক সিনিয়র কূটনীতিক বললেন, বাংলাদেশের এই নতুন চ্যালেঞ্জের কথা প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠেই উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, আমরা সেই পথে এগিয়ে যাচ্ছি। তবে কষ্ট লাগে, যখন দেখি আমরা যে সম্মান অর্জন করেছিলাম, বিশ্বের বুকে মর্যাদার আসনে আসীন হয়েছিলাম— এসব সন্ত্রাসী ঘটনায় সে সম্মানে কিছুটা হলেও ছেদ পড়ছে।’ কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন এই চ্যালেঞ্জ দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সংকটকে নিতে হবে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে, তা না হলে এই শান্তিপ্রিয় ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশিদের প্রতি বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর অবিশ্বাস ও অনাস্থা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রধানতম উপায় জঙ্গিবাদ নির্মূল করা। যে কোনোভাবেই হোক উপড়ে ফেলতে হবে অনাহৃত উগ্রবাদের শিকড়। তা না হলে হাজারো কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও ফিরিয়ে আনতে পারবে না কাঙ্ক্ষিত আস্থা ও বিশ্বাস। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের মতে, এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আগাম তথ্য পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজন বাস্তব প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি। পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনে প্রয়োজনে আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে যতটা সহযোগিতা প্রয়োজন তা নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরে যে তরুণ সমাজ আছে, যারা এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে তারা কেন এই ধরনের নেতিবাচক কাজে যুক্ত হচ্ছে সে বিষয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে তরুণ সমাজের বিক্ষুব্ধ ভাব কীভাবে কমিয়ে আনা যায় এবং কীভাবে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থায় তরুণদের বিপজ্জনক পথ থেকে সরিয়ে এনে স্বাভাবিক পথে ধরে রাখা যায় সে বিষয়েও চিন্তা করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেনের মতে, জঙ্গিবাদ নির্মূল করাই চ্যালেঞ্জ উত্তরণের একমাত্র পথ। সে জন্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ার কোনো বিকল্প নেই। সরকারকেও রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে গিয়ে নাগরিক সমাজকে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বড় বিষয় হচ্ছে সদিচ্ছা। সর্বোপরি জঙ্গিবাদ দমনে আমাদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। কোনো একটি ঘটনা ঘটলে কেবল সরকার প্রতিক্রিয়া দেখাবে— এমন অবস্থান থেকে সরে এসে সরকারকে প্রোঅ্যাক্টিভলি কাজ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর