মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

এলাকায় নেই এমপিরা

রফিকুল ইসলাম রনি

দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা এবং নদীভাঙনে লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যার্তরা সীমাহীন দুর্ভোগেও পাশে পাচ্ছেন না নিজ নিজ এলাকার এমপিদের। বন্যায় নিজেদের এলাকার দুরবস্থা দূর থেকেই পর্যবেক্ষণ করছেন এমপিরা। তবে কেউ কেউ বন্যাকবলিত এলাকায় গেলেও ব্যক্তিগত কাজ সেরে ফিরে আসেন রাজধানীতে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেওয়ার পরও মানুষের বিপদের সময় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট এলাকার অনেক এমপিকে। শুধু সরকারি দলের নয়, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এমপিরাও ঢাকায় বসে নিজেদের এলাকার বন্যা পরিস্থিতি ও লোকজনের দুরবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছেন। দুঃসময়ে বন্যার্ত মানুষ জনপ্রতিনিধিদের পাশে পাচ্ছে না বলে অভিযোগ। দেশের উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। এসব অঞ্চলে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। এদিকে ঢাকা বিভাগের মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের নিম্নাঞ্চলে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ডুবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে তারা। বানভাসি এসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে রবিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে দলীয় নেতা-কর্মী, এমপিসহ সব শ্রেণির মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকালও মন্ত্রিসভার বৈঠকে এমপি-মন্ত্রীদের বন্যা আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন। কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপি বন্যাকবলিত এলাকায় গেলেও অধিকাংশই পা দেননি নিজ নির্বাচনী এলাকায়। এ নিয়ে বানভাসি মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। লালমনিরহাটের কুলাঘাট, রাজপুর ও খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের ১৬টি চর গ্রাম; আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্ধন, আরজী ছালাপাক, চন্ডিমারী এবং কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ও তুষভাণ্ডার ইউনিয়নের ২১টি চরের মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। তাদের অভিযোগ, এখন পর্যন্ত তারা কোনো ত্রাণসামগ্রী পাননি। এ জেলায় সরকারি দলের তিনজন এমপি রয়েছেন। লালমনিরহাট-১ আসনের এমপি মোতাহার হোসেন ছাড়া গতকাল পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের পাশে অন্য দুই এমপি যাননি। তারা দুজনই এলাকার বাইরে রয়েছেন।

যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তীরবর্তী কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর উপজেলাসহ আশপাশ এলাকার বন্যাকবলিত লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে উল্লাপাড়ার নিম্নাঞ্চলও। সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ত্রাণসামগ্রী তাদের একমাত্র ভরসা। বন্যায় বাড়িঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা। এ জেলায় ছয়জন এমপি রয়েছেন আওয়ামী লীগের। দুই দিন আগে সিরাজগঞ্জ-১ আসনের এমপি ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম তার নির্বাচনী এলাকা কাজীপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম সরেজমিনের পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করে এসেছেন। এখনো এলাকার খোঁজখবর রাখছেন। সিরাজগঞ্জ ৩ ও ৫ আসনের এমপি নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করলেও বাকি তিনজন এলাকায় নেই। পাহাড়ি ঢল ও অবিরাম ভারী বর্ষণে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার দুই শতাধিক চর ও দ্বীপচরের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জেলার উলিপুর, চিলমারী, কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারীম রৌমারী-রাজীবপুর উপজেলার প্রায় ২৪টি ইউনিয়নই বন্যায় প্লাবিত। বন্যাদুর্গত এলাকায় সরকারি বা বেসরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণসামগ্রী না পৌঁছানোয় দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসি মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গোখাদ্যের সংকট। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থাও। রৌমারী-রাজীবপুর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ জেলার সংসদ সদস্য এ কে এম মাইদুল ইসলাম, রুহুল আমিন, তাজুল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান। রুহুল আমিন (জাতীয় পার্টি—জেপি) ছাড়া সবাই প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির। বন্যার শুরু থেকেই কেউ এলাকায় যাননি।

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার ৩ ইউনিয়নের ১৮টি গ্রামে পদ্মার ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। দুই দিনের ভাঙনে গ্রামগুলোর ৪ শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। প্রায় ৫০০ একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে ১টি বাজারের ৮০টি দোকান। বিদ্যালয়ের ভবন নদীতে বিলীন হওয়ায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জাজিরা ও শরীয়তপুর সদর আসনের এমপি বি এম মোজাম্মেল হক। আজ আওয়ামী লীগের টিমের সঙ্গে তিনি এলাকায় যাবেন বলে জানা গেছে। ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাটের চরাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত। নড়িয়া-সখিপুরের একাংশ বন্যায় প্লাবিত হলেও ত্রাণ পৌঁছেননি। নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডোমার ও ডিমলা উপজেলা নিয়ে গঠিত নীলফামারী-১ আসনের এমপি আফতাব উদ্দিন। জলঢাকা ও কিশোরগঞ্জের একাংশ নিয়ে গঠিত নীলফামারী-৩ আসনের এমপি গোলাম মোস্তফা। তারা দুজন বর্তমানে এলাকায় থাকলেও আরেকজন সরকারদলীয় এমপি ঢাকায় অবস্থান করছেন। টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর, কালিহাতী, নাগরপুর, গোপালপুর, মির্জাপুর ও সদর উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে এখনো ত্রাণ পৌঁছায়নি। পৌঁছাতে পারেননি এসব এলাকার সংসদ সদস্যরাও। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিপদের সময় সংসদ সদস্যরা পাশে থাকবেন, এটাই আশা করেন স্থানীয়রা। কিন্তু বেশির ভাগ সংসদ সদস্য কখনো সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেন না। তারা নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থাকেন। এর আগেও বেশ কয়েকবার বিপদের সময় মানুষ তাদের পাশে পায়নি। প্রধানমন্ত্রী বলার পরও তারা এলাকায় যাননি।

 নিজ এলাকায় বন্যাকবলিত হয়ে লাখ লাখ মানুষ দুর্বিষহ অবস্থায় থাকলেও তারা ঢাকায় আয়েশি জীবন যাপন করছেন। এর আগেও বিভিন্ন দুর্যোগের সময় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে এলাকায় না যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ ১ জুলাই গুলশানে আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর নিজ এলাকায় গিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাও কাজে আসেনি। এর আগেও একাধিকবার একই ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবির। একই বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাতে কয়েকটি এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। তখনো সাধারণ মানুষ পাশে পায়নি এমপিদের। নির্বাচিত হওয়ার পরই সংসদ সদস্যরা এলাকায় যাতায়াত কমিয়ে দেন। তারা ঢাকায় বিভিন্ন তদবির ও নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। যে কারণে প্রয়োজনের সময় এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কাছে পায় না ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর