মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

কাল রাতে ভূতের বিয়ে দেখলাম

সমরেশ মজুমদার

কাল রাতে ভূতের বিয়ে দেখলাম

বাল্যকালে আমাদের জলপাইগুড়ির বাড়িতে ইলেকট্রিক ছিল না। হ্যারিকেনের আলো যতটুকু যায় তার বাইরের পৃথিবীটা ছিল নিকষ কালো। সেদিকে তাকালেই মনে হতো কত কি ব্যাপার ওই অন্ধকারে ঘটে যাচ্ছে। রাত সাড়ে ৮টায় পড়াশোনা শেষ করে আমরা অপেক্ষা করতাম, কখন রাতের খাওয়ার ডাক আসবে। ভিতর-বাড়ির বারান্দায় শতরঞ্জি বিছিয়ে ভাইবোনেরা বসে থাকতাম উদগ্রীব হয়ে। সেখানেই উঠোনজুড়ে অন্ধকার। এই সময় ঝাড়িকাকু একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, কাল রাতে ভূতের বিয়ে দেখলাম, বুঝলি! সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা ফুটল। ওই অন্ধকারে ভূতের বিয়ে হতেই পারে। আমাদের কেউ একজন বলেছিল, —তুমি কি এখনো বেঁচে আছ ঝাড়িকাকু?

দূরে, আধা অন্ধকারে বসে থাকা ঝাড়িকাকুর গলা কানে এলো, আছি রে! ভূতের কিল খেয়ে বেঁচে আছি।

—ভূতের কিল?

—ওই কাঁঠাল গাছের ওপরের ডালে বিয়েটা হচ্ছিল। আমি গুটি গুটি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকিয়েছিলাম। বিয়ের খাওয়া-দাওয়া চলছিল ওপরে। যদি ওদের হাত ফসকে কিছু খাবার নিচে পড়ে যায় তাহলে লুফে নেব। হঠাৎ পিঠে প্রচণ্ড জোরে কেউ কিল মারল। উপুড় হয়ে পড়ে গেলাম। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ওইভাবে শুয়ে থাকলাম, যতক্ষণ না বর-কনে বিদায় নিচ্ছে। তারপর চুপচাপ ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।

সকালে কাজের মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, তোমার হাত কেটে গেল কী করে? মুখে দাগ কেন?

বুঝলাম পড়ার সময় কাটা ঝোপের ওপর পড়েছিলাম। কিন্তু ভূতের বিয়ের কথা বললে মেয়েটা হাসাহাসি করবে বলে মিথ্যে বললাম, কলতলায় পড়ে গেছি। কিলটাকে মুখ বুজে হজম করলাম। ঝাড়িকাকু বলল।

ঠাকুরদার আমলের কাজের লোক ঝাড়িকাকু। বিশ্বাস না করে উপায় নেই। তবু বললাম, তুমি মিছে কথা বললে?

তোরা বুঝবি না। ভূতের কিল হজম করতে হয়। এই মিথ্যেতে দোষ লাগে না।

ছেলেবেলায় শোনা এই কথাগুলো সারা জীবন ধরে কত না চেহারায় বোধগম্য হলো। এক বন্ধুর হাতের লেখা ছিল খুব খারাপ। তাই প্রেমে পড়ার পর বেচারা আমার কাছে এলো তার হয়ে প্রেমপত্র লিখে দিতে। প্রবল উৎসাহে এই বই ওই বই ঘেঁটে কোটেশন জোগাড় করে আমি একটার পর একটা প্রেমপত্র লিখে যাচ্ছি। উত্তর পেলে বন্ধু এনে দিচ্ছে। পড়ে আরও উৎসাহিত হয়ে লিখছি। কী লিখতে হবে তা বন্ধু নির্দেশ দিচ্ছিল না। দেখলাম মেয়েটি বেশ বুদ্ধিমতী। চিঠিতে আমার সান্ধভাষা ঠিক বুঝতে পারছে। একদিন ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেল মেয়েটির বাবা-মায়ের কাছে। চিঠির নিচে নাম দেখে বন্ধুকে ডেকে পাঠালেন ক্ষিপ্ত হয়ে। সে গিয়ে অস্বীকার করল। বলল, তার নামে অন্য কেউ লিখে দিয়েছে, সে লেখেনি।

হাতের লেখা পরীক্ষা করে বাবা-মা বুঝতে পারলেন বন্ধু মিথ্যে বলেনি। তাহলে কে লিখেছে? হেডমাস্টার মশাই আমাদের সব ছেলের হাতের লেখার নমুনা নিলেন। চিঠিগুলো আমি রবীন্দ্রনাথকে নকল করে লিখেছিলাম বলে আমি ধরা পড়লাম না। ভাবলাম, বেঁচে গেছি। তখনো আমি মেয়েটাকে চোখে দেখিনি। তারপর কলকাতায় পড়তে চলে এসেছি। স্কটিশের দ্বিতীয় বছরে জলপাইগুড়ির যে মেয়েটি প্রথম বর্ষের ছাত্রী হয়ে এলো সে একদিন আমার কাছে এলো। বলল, আপনি সমরেশ, অন্যের হয়ে চিঠি লিখতেন, নিজের নাম লেখার সাহস আপনার হয়নি?

চমকে তাকিয়েছিলাম। তারপর বেমালুম বলেছিলাম, ভুল করছেন। আমি কারও হয়ে চিঠি লিখিনি।

মানে? সে উত্তেজিত হয়ে জানাল, বন্ধু তার কাছে স্বীকার করেছে চিঠিগুলো তার হয়ে আমি লিখেছি।

বেমালুম মিথ্যে বললাম, ও সত্যি কথা বলেনি। মিথ্যে বলতে ওর বাধে না।

বলে সরে গিয়েছিলাম। মেয়েটি আর কখনো আমার সামনে আসেনি। বলা যেতে পারে, আমি কখনো মেয়েটির সামনে যাইনি। কিলটা হজম করে নিয়েছি চুপচাপ।

আমার এক বন্ধুর তাসের নেশা ছিল প্রচুর। খেলতে বসে সময় ভুলে যেত সে। বাড়ি ফিরে একটা না একটা মিথ্যে কথা প্রায় বলতে হতো। কিন্তু মিথ্যেগুলো যখন পুরনো হয়ে যাচ্ছিল তখন বাড়িতে তীব্র আপত্তি। সেই খবর পেয়ে ওর মা এলেন দেশ থেকে।

বন্ধু অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফিরে আসে। স্ত্রী খুশি। সেটা জানুয়ারির মাঝামাঝি। তীব্র শীত চলছে। বয়স্কদের কথা এড়াতে না পেরে সে আবার তাদের আসরে বসল। ঠিক করল ৯টা বাজলেই উঠে যাবে। কিন্তু উঠল রাত ১টায়। চটপট একটা গামছা জোগাড় করে বাড়ি ফিরল দেড়টার সময়। হাতে ভেজা গামছা। দরজা খুলে মা যখন রেগে অগ্নিশর্মা তখন বন্ধু জানাল তার পরিচিত একজনকে দাহ করতে শ্মশানে গিয়েছিল। ভেজা গামছা দেখিয়ে বলেছিল, এই দ্যাখো, স্নান করে ফিরছি।

মা থতমত হয়ে বললেন, তুই এই জামা-প্যান্ট পরে শ্মশানে গিয়েছিলি?

—হ্যাঁ।

—সর্বনাশ! যা, এখনই ওসব ছেড়ে আবার স্নান করে নে। বউমা, ওকে কাচা পাজামা দাও। মা বলেছিলেন।

সেই শীতলতম রাতে বেচারাকে ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে হয়েছিল। এটাকে কিল খেয়ে কিল হজম অবশ্যই বলা যায়।

এই যে যারা রেসের মাঠে যান, তাদের পকেটে কত টাকা থাকে তারা ছাড়া কেউ জানে না। পৃথিবীর কোনো রেসকোর্সে কেউ দিনের পর দিন জেতে না। দশটার মধ্যে একটা জিতলে ন’টায় হারতে হয়। তবু মানুষ যায়। রেস শেষ হলে মুখ গম্ভীর হলেও জিজ্ঞেস করলে শুনবেন, না, বেশি হারিনি। সামান্যই।

তখন হয়তো যা এনেছিলেন তা নব্বই ভাগ পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে। বাড়ি ফিরেও কাউকে এরা বলেন না, অত টাকা হেরে এসেছি। কিল খেয়ে তা হজম করতে এরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছেন রাজনৈতিক নেতারা। নির্বাচনের আগে নেতারা যে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন তাতে বিগলিত হয়ে আমরা দলে দলে ভোট দিয়ে থাকি। জেতার পর যখন তাদের চেহারা বদলে যায় তখন আমাদের কিছুই করার থাকে না। মুখ বুজে হজম করতে হয় কিলগুলো।

সর্বশেষ খবর