বুধবার, ৩ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

সব রহস্য তামিম জিয়াকে ঘিরে

গুলশান-শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা, দেশজুড়ে টার্গেট কিলিংয়ের নেতৃত্বে এরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সব রহস্য তামিম জিয়াকে ঘিরে

তামিম আহমেদ চৌধুরী - মেজর (বরখাস্ত) জিয়াউল হক

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলাসহ দেশে সাম্প্রতিক উগ্রপন্থি কর্মকাণ্ডের পেছনে রয়েছেন কানাডার পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি তামিম আহমেদ চৌধুরী ও সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক। অপরাধ পরিকল্পনায় তাদের সহযোগী ছিল তাহজীব করিম ও রেজাউর রাজ্জাক। দ্বিতীয় স্তরে থেকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করেন সালাউদ্দিন, সুলেমান ও রাজিব। বাংলাদেশের স্থানীয় তরুণদের নিয়ে গড়ে ওঠা এই জঙ্গি নেটওয়ার্ক শুধু ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সঙ্গে নয়, তারা আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছে বিভিন্ন সময়ে। এর মধ্যে লস্কর-ই-তাইয়্যেবা, তেহরিক-ই-তালিবান ও জইস-ই-মোহাম্মদের মতো গোষ্ঠী অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে এসব গোষ্ঠীর লজিস্টিক সাপোর্ট নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও বাংলাদেশে মূল কর্মকাণ্ড চালিয়েছে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম—এবিটি বা আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ এর নতুন নেতৃত্ব। সাম্প্রতিক তদন্তে প্রাথমিক এই জঙ্গি নেটওয়ার্কের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দারা। এর মধ্যে গতকাল তামিম ও জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছে পুলিশ। পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক গতকাল পুলিশ সদর দফতরে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যা পেয়েছি, এখানে মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী। নতুন জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছে সে। এই তামিম চৌধুরীর পর যারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদেরকে আমরা গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। আরেকটা গ্রুপ আছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সেখানে তদন্তে আমাদের ধারণা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া। পুলিশ তামিম ও জিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে।’

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বাংলাদেশে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা থেকে ২০১৪ সালে একসঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনা নেয় দেশীয় জঙ্গি গ্রুপগুলো। সে বছরই ঢাকার নিকটবর্তী একটি কারাগারে আটক জেএমবি, এবিটি ও হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ জঙ্গিরা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়। এই সিদ্ধান্তের পরই গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের পাশাপাাশি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কগুলোও কাজে লাগানো শুরু করে। রেজাউর রাজ্জাক নামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জেএমবি ও আনসার আল বাংলাদেশের পুনর্গঠনে নানান ধরনের আন্তর্জাতিক সাহায্যের সমন্বয় করেন। তাকে সরাসরি সাহায্য করেন পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ায় থাকা একাধিক ব্যক্তি। তারা সবাই কাজ করেছেন তামিম ও জিয়ার নির্দেশনায়। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন জেএমবির তেহজীব করিম। অপারেশনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্বে চলে আসেন ত্রিশালে পুলিশ ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সাবেক জেএমবি শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন। যুক্ত হয় সুলেমান, রাজিব ওরফে শান্ত ওরফে আদিল। সে বছরে আইএস ও আল-কায়েদা ভারতে শাখা করার ঘোষণা দিলে এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও অনেকে। যুক্ত হয় জাপানের নাগরিকত্বধারী বাংলাদেশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাইফুল্লাহ ওজাকি। অস্ট্রেলিয়া থেকে নিখোঁজ লক্ষ্মীপুরের এ টি এম তাজউদ্দিন ও মালয়েশিয়া থেকে নিখোঁজ চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার নজিবুল্লাহ আনসারী। ঢাকার বাসিন্দা ও কুমিল্লার জুন্নুন শিকদার। এর মধ্যে জুন্নুন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর সঙ্গে সন্ত্রাস দমন আইনের মামলার আসামি হয়ে নিখোঁজ হন। সাইফুল্লাহ ওজাকি ওরফে আবু মুসা বাংলাদেশে আইএসের কর্মী সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন। তেহজীব করিম ছিলেন অর্থায়নের দায়িত্বে। ঢাকায় ‘রিসার্চ সেন্টার ফর ইউনিটি ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘আরসিইউডি’ নামে একটি এনজিও’র মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করছিলেন তেহজীব ও তার ভাই রাজিব করিম। তেহজীবের ভাই ও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সাবেক আইটি প্রকৌশলী রাজিব করিম এর আগে ২০১১ সালে প্লেনে বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করে আটক হন। আর তেহজীব বাংলাদেশে তিন বছর আগে গ্রেফতার হলেও পরে জামিনে মুক্ত হন। তাদের এনজিওর সঙ্গে ইয়েমেনভিত্তিক একিউএপি বা আল-কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সূত্র পেয়েছে গোয়েন্দারা। এই এনজিওর পেছনে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন বনানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউর রাজ্জাক। মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক রেজাউর রাজ্জাক প্রথমে জেএমবির পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখলেও পরে জর্ডানভিত্তিক জামায়েতুল মুসলেমিনের বাংলাদেশ শাখা স্থাপনে মনোযোগী হন। গোয়েন্দাদের মতে, অধ্যাপক রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠ রেদওয়ানুল আজাদ রানা ও জুন্নুন শিকদার ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যায় জড়িত ছিলেন।

কে এই তামিম : গত ১৩ এপ্রিল অনলাইনে প্রকাশিত আইএসের নিজস্ব সাময়িকী ‘দাবিক’-এর ১৪তম সংখ্যায় আইএসের কথিত বাংলাদেশ প্রধান হিসেবে শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের নাম ঘোষণা ও দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। এতে জানানো হয়, কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি করতে চায় আইএস। কানাডার পত্রিকা ন্যাশনাল পোস্ট এ মাসের শুরুতে প্রকাশিত খবরে বলেছে, আইএসের কথিত ‘বাংলার খিলাফত দলের প্রধান’ শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক। তার প্রকৃত নাম তামিম আহমেদ চৌধুরী। তিনি কানাডা থেকে বাংলাদেশে চলে গেছেন। বাংলাদেশের পুলিশ বলছে, সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর দুবাই থেকে বাংলাদেশে আসা তামিম চৌধুরী গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের হামলার পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, সার্বিক অর্থায়ন-সবকিছুর সঙ্গেই জড়িত। তার বাবার নাম শফিক আহমেদ চৌধুরী। মায়ের নাম খালেদা শফি চৌধুরী। বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বড়গ্রামফাদিমাপুরে। জন্ম ১৯৮৬ সালের ২৫ জুলাই। তামিম কানাডার উইন্ডসর শহরে থাকতেন। সেখানে বসেই আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ গড়েন। তার দাদা মজিদ চৌধুরী ছিলেন সিলেটে একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য। তামিমের বাবা শফিক আহমেদ চৌধুরী জাহাজে চাকরি করতেন, একাত্তরের পরপরই সপরিবারে কানাডা চলে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তবে তামিম কখনো বিয়ানীবাজারের বাড়িতে আসেনি। তার জন্ম কানাডায়। সেখানেই বেড়ে ওঠা। তামিম বিবাহিত। তিন সন্তানের বাবা। আত্মীয়দের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই। গোয়েন্দাদের ধারণা, গুলশান ও কিশোরগঞ্জে হামলার পরই সীমান্ত পার করে ভারতে ঘাঁটি গেড়েছিলেন তামিম। পরে তিনি আবার ফিরে আসেন। তবে এখন তিনি দেশে, না বিদেশে আছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার জন্য তামিমসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।

কে এই জিয়া : পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া মেজর তিনি। তার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। সর্বশেষ ব্যবহূত ঠিকানা পলাশ, মিরপুর সেনানিবাস, ঢাকা। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান চেষ্টার অন্যতম পরিকল্পনা করেছিলেন জিয়া। তখনই তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং এরপর থেকে জিয়া নিখোঁজ। গত দুই বছরে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক-প্রকাশক, বিদেশি নাগরিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যার প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আবারও জিয়ার নাম আলোচনায় আসে। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ‘ডন’-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৯ জানুয়ারি করাচিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এক বন্দুকযুদ্ধে একিউআইএসের কমান্ডার এজাজ ওরফে সাজ্জাদসহ আল-কায়েদার চার জঙ্গি নিহত হয়। পরে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত গোয়েন্দারা কমান্ডার এজাজ নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত হন। এজাজের মৃত্যুর পরে আনসারুল্লাহ নতুন নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয়। জসীমউদ্দীন রাহমানীর স্থলে তাত্ত্বিক নেতা হন পুরান ঢাকার ফরিদাবাদের এক মাদ্রাসাশিক্ষক। আর সামরিক শাখার নেতৃত্বে আসেন মেজর (বহিষ্কৃত) সৈয়দ মো. জিয়াউল হক। জিয়া এই জঙ্গিগোষ্ঠীর সামরিক শাখার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি ব্লগার হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলা এত বেশি নিখুঁতভাবে হয় যে ঘাতকদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা কঠিন হয়ে পড়ে।

সর্বশেষ খবর