সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

১৭ বছরে ভয়ঙ্কর জঙ্গিরা

পরিবর্তন এসেছে সদস্য সংগ্রহ ও অর্থায়নে । চাপাতির স্থানে অটোমেটিক অস্ত্র । দৃষ্টি যখন মাদ্রাসায়, ওরা তখন নামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে । টার্গেট উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার । সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার । নিত্যকৌশলে মার খাচ্ছে গোয়েন্দারা

মির্জা মেহেদী তমাল

১৭ বছরে ভয়ঙ্কর জঙ্গিরা

১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি। কবি শামসুর রাহমানের রাজধানীর শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে আঘাত করে একদল দুর্বৃত্ত; এতে গুরুতর জখম হন তিনি। চিৎকার-চেঁচামেচিতে লোকজন এগিয়ে এসে চার দুর্বৃত্তকে পাকড়াও করে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ধারালো অস্ত্র। বাকিরা লাপাত্তা। এরা কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। পুলিশি জেরায় স্বীকার করে, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ-এর সদস্য তারা। ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করা এই জঙ্গি সংগঠনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ এমনকি গোয়েন্দাদেরও তখন স্বচ্ছ কোনো ধারণা ছিল না। তাদের আকস্মিক এমন দুঃসাহসিক অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হতবাক। ভাবিয়ে তোলে সরকারকেও। মাদ্রাসা ঘিরে চলে গোয়েন্দা নজরদারি। তবে নজরদারি এড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একে একে বোমা হামলা হয়। লাশ পড়ে, রক্ত ঝরে।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একটি জেলা বাদে দেশের সবকটি জেলায় একযোগে পাঁচ শতাধিক বোমা হামলা চালায় আরেক জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মোজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের শক্তিমত্তার প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়। পুলিশি অভিযানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রেফতার হয় জঙ্গি সদস্যরা। এদের প্রত্যেকেই মাদ্রাসার ছাত্র। গোয়েন্দা তথ্য মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের অভিযান অব্যাহত রাখে। মাঝে-মধ্যে গ্রেফতার হয় জঙ্গি সদস্যরা। দাবি করা হয় আস্তানা আবিষ্কারের।

১১ বছর পর ১ জুলাই রাতে গুলশানে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মাপের জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। কয়েক স্তরের নিরাপত্তায় বেষ্টিত কূটনৈতিক এলাকার ক্যাফে আর্টিজানে হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর আগে গুলিবিনিময়ে নিহত হন দুই পুলিশ। রাত পোহানোর পর কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। পাঁচ জঙ্গির মধ্যে তিনজনের পরিচয় প্রকাশের পর দেশের মানুষ হতবাক হয়ে যায়। এই জঙ্গিরা পড়াশোনা করেছেন নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। একজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, একজন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরজন স্কলাস্টিকা স্কুলের ছাত্র। ঈদের দিন শোলাকিয়ায় হামলায় নিহত জঙ্গিও ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এর কদিন পরেই সিরিয়া থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের পক্ষ থেকে তিন বাংলাদেশি তরুণ হুমকি দিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠায়। ওই তিন তরুণের একজন ঢাবির আইবিএতে পড়তেন, একজন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরজন চিকিৎসক। এদের প্রত্যেকেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। দেশে জঙ্গি তত্পরতার এমন আমূল পরিবর্তনে পুলিশ ও গোয়েন্দারা বিস্মিত। মাত্র ১৭ বছর আগে ছোরা-চাক্কু নিয়ে মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্রের হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে উগ্রপন্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল, হালে তা ভয়ঙ্কর রূপ পেয়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে জঙ্গি তত্পরতার সর্বক্ষেত্রে। পক্ষান্তরে জঙ্গি তত্পরতা রোধ করা যাদের দায়িত্ব, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের এই পরিবর্তন ধরতেই পারেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতিমধ্যে ছয়টি জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও বন্ধ হয়নি তাদের তত্পরতা। জঙ্গি তত্পরতা বর্তমানে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা গোয়েন্দাদের ধারণার বাইরে। গোয়েন্দারা যখন মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি করে, ঠিক তখনই জঙ্গি তত্পরতা চলছে নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেশের অজপাড়াগাঁয়ে নিম্নবিত্তদের জঙ্গিতে জড়িয়ে পড়ার বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গবেষণায় ব্যস্ত থাকার সময়ে জঙ্গি তত্পরতা দেশের উচ্চবিত্ত পরিবারে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। সদস্য সংগ্রহ, অর্থায়ন থেকে শুরু করে অস্ত্র চালনাতেও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। চাপাতির স্থানে এসেছে অটোমেটিক অস্ত্র। যোগাযোগে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত এখন জঙ্গি সদস্যরা। আর্টিজানে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হলেও আধুনিক অ্যাপস ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয় হামলাকারীরা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গি তত্পরতার এই আমূল পরিবর্তনের বিষয়ে গোয়েন্দাদের কোনো ধারণাই ছিল না। জঙ্গি তত্পরতা কোন পর্যায়ে রয়েছে, এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে অন্ধকারে। নিত্যনতুন কৌশলের কাছে বার বার মার খাচ্ছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কোথা থেকে আসছে, অর্থায়ন কারা করছে, মাস্টারমাইন্ড কারা— কোনো তথ্যই গোয়েন্দারা হালনাগাদ করতে পারছে না। পুরনো ধ্যান-ধারণা পেছনে ফেলে জঙ্গি তত্পরতা ভয়ঙ্কর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও গতিশীল হতে হবে। গোয়েন্দাদের আরও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় হলি আর্টিজানের মতো আবারও বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকেই যাবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, আমাদের স্বাধীনতাবিরোধীরা সক্রিয়, বিশ্বায়িত জঙ্গিবাদের উত্থান আমাদের দেশের উগ্রপন্থিদের  প্রভাবিত করেছে, দেশে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি— এই চার কারণে চরম জঙ্গিবাদের বিকাশ ঘটেছে দেশে। রাজনীতির উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদ ঢোকানো হয়। রাজনীতিতে জঙ্গিবাদকে ব্যবহারের চিন্তাভাবনা করে এসেছে আফগান যুদ্ধফেরতরা। এরপর তাদের সংগঠন দেখলাম। এরপর দেখছি সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা। তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা আছে, আছে অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। এই দুটো হলো গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের জঙ্গি তত্পরতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, গোয়েন্দা সংস্থার এমন একজন কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিকভাবে সক্রিয় প্রধান দুটি ইসলামী জঙ্গি সংগঠন হচ্ছে আল-কায়েদা এবং ইসলামী স্টেট বা আইএস। এর মধ্যে আল-কায়েদার প্রতি উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের ঝোঁক কম। এখানে মাদ্রাসা থেকে পাস করা তরুণের সংখ্যাই বেশি। অন্যদিকে আইএসের প্রধান টার্গেট হচ্ছে উচ্চশিক্ষিত, স্মার্ট ও ইংরেজি জানা তরুণ-তরুণী। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামী স্টেট বা আইএস গুলশানের হামলাকারীদের তাদের সংগঠনের সদস্য বললেও বাংলাদেশ সরকার এদের স্থানীয় জঙ্গি হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের আরেক জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বি-টিম। যারা আইএসকে সমর্থন করে থাকে। সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামী স্টেট বা আইএস তাদের সংগঠনের সমর্থক ও সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত সন্তানদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে সিরিয়া, ইরাক যাওয়া বা যারা নিখোঁজ রয়েছেন— মনে করা হচ্ছে তারা আইএসে যোগদান করেছেন। এদের প্রত্যেকেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটকে কাজে লাগান।

উচ্চবিত্তের স্মার্ট উচ্চশিক্ষিত সন্তানরা কেন টার্গেট : সূত্র জানায়, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণরাই ইন্টারনেট বেশি ব্যবহার করে থাকে। এরা ইংরেজি ভাষা ভালো জানে। নেট থেকে আইএসের বিভিন্ন ফিচার, লেখা, আর্টিকেল, গাইডলাইন ডাউনলোড করে নিতে পারে। সূত্র মতে, আইএস আর্থিকভাবে ভালো অবস্থানে থাকা পরিবারের সদস্যদের যথেষ্ট প্রাধান্য দিয়ে থাকে। সমাজে এই পরিবারগুলো প্রভাবশালী হয়ে থাকে। এই পরিবারগুলোকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘাঁটায় না। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়েও থাকে তাদের যোগাযোগ। কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই এই পরিবারের সন্তানদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। অন্যদিকে আর্থিকভাবে সচ্ছল এই তরুণদের প্রভাব থাকে তাদের বন্ধুবান্ধবদের ওপর। এভাবে বন্ধুবান্ধবদেরও এই পথে আনা সম্ভব হয়।

তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ : ধনী পরিবারের সদস্যরা তথ্য প্রযুক্তিতে পারদর্শী হয়। বিভিন্ন মতাদর্শ প্রচার, নতুন নতুন মানুষের মগজ ধোলাই, সিনেমাটিকভাবে বিভিন্ন নৃশংসতার ঘটনা প্রচার, গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের নামে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা, অনলাইনধর্মী প্রকাশনা চালানো ইত্যাদির জন্য দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। সূত্র জানায়, ধনী বা প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা জঙ্গি সংগঠনে যোগদান করলে তা প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এতে করে ওই জঙ্গি সংগঠনেরও ব্যাপক প্রচার হয়ে থাকে।

ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা : বেশির ভাগ ধনী পরিবারের সন্তানদের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান খুব কম থাকে। এই সুযোগটাও নেয় সংগঠনগুলো। ধর্মের অপব্যাখ্যা দেওয়া যায় খুব সহজেই। সূত্র জানায়, হতাশাগ্রস্ত, পারিবারিক অশান্তি, সম্পর্কে টানাপোড়েনে রয়েছেন উচ্চবিত্ত পরিবারের এমন তরুণরা বেশি টার্গেটের শিকার হচ্ছেন। এদের ব্রেইনওয়াশ করা খুব সহজ বলে মনে করা হয়ে থাকে।

র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ বাবা-মা সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রে কোচিং ও গৃহশিক্ষকের ওপরই বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। ওই শিক্ষকরা তার সন্তানকে কী পড়াচ্ছে তারও খুব একটা খোঁজ নিচ্ছেন না তারা। এতে করে শিক্ষার ব্যাপারে সন্তান এবং মা-বাবার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। অনেক অভিভাবক আকাশ সংস্কৃতির দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার কারণে সন্তানের দিকে সময়ই দিতে পারছেন না। এ সুযোগে সন্তানরা বিপথে পা দিচ্ছে। মনোবিজ্ঞানী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূর মোহাম্মদ লিমন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাবা-মায়ের উচিত হবে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। এ জন্য দরকার পারিবারিক সচেতনতা। সন্তানের আবেগ-অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সন্তানের আচরণে কোনো ধরনের পরিবর্তন দেখা দিলে প্রথমে নিজেরা, তাতে কোনো কাজ না হলে কাউন্সিলর এবং মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো সময় ক্ষেপণ করা উচিত হবে না। তাতেও কাজে না এলে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিতে হবে। মনোচিকিৎসক ড. মোহিত কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিশোরদের তথা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী তরুণদের মন হয় ‘কাঁচামাটি’র মতো। তাদের ‘রিজোনিং পাওয়ার’ খুব কম থাকে। তাদের অনুভূতিও অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। এ বয়সে তাদের যেভাবে বোঝানো হবে তারা ঠিক সেভাবেই বুঝবে। এমনকি তাদের সহজেই ‘মোটিভেট’ও করা যায়। আর এ সুযোগেই অসাধু ব্যক্তিরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই তরুণদের ব্যবহার করে। অথচ যারা এর শিকার হচ্ছে অর্থাৎ সেই কিশোর-তরুণ জানেই না যে তারা কী করছে!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর