সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভুঁইফোড় সংগঠনের শেষ নেই আওয়ামী লীগে

রফিকুল ইসলাম রনি

ভুঁইফোড় সংগঠনের শেষ নেই আওয়ামী লীগে

নামের আগে ‘আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল, জননেত্রী, মুক্তিযুদ্ধ ও ডিজিটাল’ শব্দ জুড়ে দিয়ে প্রায় দুই শতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে ওঠার পর এবার নতুন সংস্করণ হলো ‘বাংলাদেশ আওয়ামী সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ’। মূল দল আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের স্বীকৃতি না থাকলেও এর সংগঠকরা নিজেদের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করে বিভিন্ন দফতরে সুবিধা আদায় ও নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর গত সাড়ে সাত বছরে দলটির নামের সঙ্গে মিল রেখে আত্মপ্রকাশ করেছে এমন দুই শতাধিক সংগঠন, যা ‘রাজনৈতিক দোকান’ নামেও পরিচিত মিডিয়াপাড়ায়। কেন্দ্রীয়ভাবে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় উত্তরোত্তর এমন সংগঠনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে বলে জানা গেছে। বরং কেন্দ্রীয় কিছু নেতা নিজেদের প্রচারের স্বার্থে এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে নিয়মিত যাচ্ছেন এবং বলক্তৃতাও করছেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, দলের কিছু সমর্থক নামসর্বস্ব কিছু সংগঠন গড়ে তুলে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। ক্ষমতায় আসার পর এসব সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘এটাও সত্যি আমাদের কোনো কোনো নেতা এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে যান। সেখানে বক্তব্য দিয়ে তারা নিজেদের জিইয়ে রাখেন, যা সত্যি দুঃখজনক।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘কিছু নামসর্বস্ব সংগঠনের খবর শুনি। এদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি বলেন, ‘এসব সংগঠনের ব্যাপারে কী করা যায় তা নিয়ে আমাদের ফোরামে আলোচনা চলছে। শিগগিরই এগুলোর লাগাম টানা হবে।’ সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘দলের রাজনীতিকে ব্যবহার করে চলছে এসব চাঁদাবাজি, ধান্দাবাজি। আমি মনে করি তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ এর আগে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসব সংগঠনের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করে এগুলোকে বলেছিলেন, ‘ধান্দাবাজির রাজনৈতিক দোকান’। সূত্রমতে, যথেচ্ছভাবে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নাম ব্যবহার করে গজিয়ে ওঠা এসব সংগঠনকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ‘ধান্ধাবাজি সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এদের লাগাম টেনে ধরার কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ে না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে স্বীকৃত সাতটি সহযোগী ও দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাড়া ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা শত শত ভুঁইফোড় সংগঠনের দায় নেতারা নিতে চান না। তবে এগুলোর নানা কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা ও মন্ত্রী অংশ নিয়ে এসব সংগঠনকে বৈধতা দিতে দেখা গেছে। জানা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নামে ১২-১৩টি সংগঠনের কার্যক্রম ছিল। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর নামসর্বস্ব সংগঠনের পেছনে ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহার ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেলসহ বিভিন্ন নামে শতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে ওঠার পর এবার সুযোগসন্ধানীদের চোখ পড়েছে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র  ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দিকে। ‘বাংলাদেশ আওয়ামী সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ’ নামের সংগঠনটির সাইনবোর্ডের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেছে। তবে সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে নয়, কেরানীগঞ্জে। কেন এই সংগঠনের আবির্ভাব? এ প্রশ্ন জানার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছিল সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসু সরদারের সঙ্গে। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই তিনি এমন একটি সংগঠন করার স্বপ্ন দেখে আসছিলেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে শিগগিরই জাতির সামনে সংগঠনের জানান দেবেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ছোট সময় থেকে এমন একটি সংগঠন করব এমন চিন্তা করে আসছিলাম। বছরখানেক আগে সজীব ওয়াজেদ জয় ভাইয়ের এক চাচাতো ভাই শামীম ভাইসহ আমরা কয়েকজন উপদেষ্টাদের পরামর্শে অনেক পরিশ্রম করে এ সংগঠন গড়ে তুলেছি। ছয় মাস ধরে পরিশ্রম করে ১০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ কয়েকটি জেলা কমিটি দিয়েছি।’ এ সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা জড়িত বলেও তিনি জানান। সংগঠনের পুরো নাম ‘বাংলাদেশ আওয়ামী সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ’। যে ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই দিন ধরে ঘুরছে, তাতে লেখা রয়েছে ঢাকা জেলা কমিটির কার্যালয়ের ঠিকানা—কালীগঞ্জ বাজার, চৌধুরী মার্কেট, কেরানীগঞ্জ ঢাকা-১৩১০। এই কমিটির আহ্বায়ক রনি আহম্মেদ কেরানীগঞ্জে ব্যবসা করেন। কার্ডটিতে তার দুটি মোবাইল ফোন নম্বরও দেওয়া রয়েছে। তবে ওই নম্বর দুটিতে একাধিকবার যোগাযোগ করে সেগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে। জানুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজের মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করে ব্যানার ছাপিয়ে আলোচনায় আসে ‘অভিভাবক লীগ’। এর আগে এ সংগঠনের নাম শোনেনি কেউ। শুধু অভিভাবক লীগই নয়, জানুয়ারিতে গঠন করা হয়েছে ‘ইতিহাস চর্চা লীগ’ ও ‘অধিকার আদায় লীগ’ নামে দুটি সংগঠন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো দল ক্ষমতায় এলেই এর ভিতরের বা বাইরের ব্যক্তি রাজনৈতিক সংগঠনটির নাম ভাঙিয়ে স্বার্থ হাসিলে উঠেপড়ে লাগে। গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, মূল দলের সঙ্গে মিল রেখে নানা সংগঠন খুলে চাঁদাবাজি বা সরকারি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে এরা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ’জাতীয়তাবাদী’ বা ‘জিয়া’ তকমা লাগিয়ে গজিয়ে ওঠে এসব সংগঠন। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘বঙ্গবন্ধু’ বা ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘আওয়ামী’ শব্দ ব্যবহার করে গঠন করা হয় নানা সংগঠন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলাসহ কয়েকটি সংগঠন ছাড়া বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব কাগজে-কলমে। একই ব্যক্তি একাধিক সংগঠনের মালিক। একেক দিন একেক সংগঠনের নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তারা। প্রায় সব অনুষ্ঠানে ঘুরেফিরে হাতে গোনা কয়েকজন ব্যক্তিকে দর্শক-শ্রোতার আসনে দেখা যায়। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ‘দেশরত্ন সেবক সংঘ’ নামে একটি ভুঁইফোড় সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। গণতন্ত্র রক্ষা পরিষদ, জনতার প্রত্যাশা, স্বাধীনতা পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু মানবকল্যাণ পরিষদসহ নানা নামে ৩৪টির বেশি কাগুজে সংগঠনের উদ্যোক্তা কৃষক লীগের সাবেক এক নেতা। মহানগর আওয়ামী লীগের আরও এক নেতা গড়ে তুলেছেন ২২টি সংগঠন। এই দুজনের ৫৬টি সংগঠনের প্রায় সব কটির নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নাম ব্যবহার করে। এর বাইরে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করেও কিছু সংগঠন বানিয়েছেন তারা। মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ নামের সংগঠনটি সাত ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। নেতৃত্বে আছেন আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক আসাদুজ্জামান দুর্জয়, ফয়েজ উল্লাহ, ফাতেমা জলিল সাথী, মাহমুদুর রহমান রাজা ও কেটু। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ রাসেলসহ বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা ভুঁইফোড় সংগঠনগুলো হলো—জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, আওয়ামী প্রচার লীগ, পর্যটন লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গবন্ধু গ্রামডাক্তার পরিষদ, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, আমরা মুজিব সেনা, মুজিব হব, চেতনায় মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি, জননেত্রী পরিষদ, দেশরত্ন পরিষদসহ দুই শতাধিক ভুঁইফোড় সংগঠন। অধিকাংশের সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ লেখা থাকলেও কার্যত সেখানে এসব সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর