বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

‘জিঞ্জিরা শিল্প’ সম্ভাবনার অবিস্মরণীয় উত্থান

সাঈদুর রহমান রিমন

‘জিঞ্জিরা শিল্প’ সম্ভাবনার অবিস্মরণীয় উত্থান

রাজধানীঘেঁষে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা এলাকা। এখানেই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দুই হাজার কারখানা। দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। ফ্লাস্ক থেকে শুরু করে গাড়ি কিংবা বিশ্বখ্যাত আইফোনের নকলও তৈরি হয় এখানে। অক্ষরজ্ঞানহীন বা স্বল্পশিক্ষিত যুবকরাই মূলত ওই শিল্পের কারিগর। চীনের প্রযুক্তিপণ্য দেখে যারা বিস্মিত হন, তারা কেরানীগঞ্জে গেলে দেখতে পাবেন প্রতিভাবান কর্মীদের তাক লাগানো যত আবিষ্কার। পৃথিবীর যে কোনো পণ্য বা যন্ত্রাংশ একবার দেখলেই তারা হুবহু বানিয়ে দিতে পারেন। গুণেমানেও বিদেশি পণ্যকে হার মানায়। সামান্য একটু সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই জিঞ্জিরা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের চীন-জাপান, যা বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতি।

জিঞ্জিরার হালকা প্রকৌশল শিল্পের মাধ্যমেই পূরণ হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাশছোঁয়া স্বপ্ন। এখানে উৎপাদিত অনেক পণ্যই দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দূরে থাক, উল্টো ‘নকলবাজ’ হিসেবে দুর্নামের সিলমোহর মারা এই ‘ইঞ্জিনিয়ারদের’ কপালে। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি (বাইশিমাস) সূত্রে জানা যায়, দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের হালকা প্রকৌশল শিল্পে বছরে টার্নওভার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আসে আড়াইশ কোটি টাকারও বেশি। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ৬ লক্ষাধিক কর্মীসহ পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ৬০ লাখ মানুষের ভাগ্য।

জিঞ্জিরার আগানগর, বাঁশপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকার বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কারখানা, যেখানে ফ্লাস্ক, ওয়াটার হিটার, শ্যাম্পু, সাবান, আফটার শেভ লোশন, ত্বকে ব্যবহারের নানারকম ক্রিমসহ বিদেশি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের হুবহু পণ্য তৈরি হয়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কিছুদিন আগেও চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের যন্ত্রাংশের একচেটিয়া দখল ছিল বাংলাদেশের বাজার। অল্প দিনের মধ্যেই জিঞ্জিরায় তৈরি যন্ত্রাংশ সেই স্থান পূরণ করে চলছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় নিজেদের তৈরি মূল্যবান সব যন্ত্র-সরঞ্জামের গায়েও মেড ইন চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামে সিলমোহর মেরে তা বাজারজাতে বাধ্য হন তারা।

কী না হয় জিঞ্জিরায়? : জিঞ্জিরায় তিনটি পৃথক এলাকায় তৈরি করা পণ্যের নামানুসারে তিনটি স্থান আছে; যেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কারখানা। তাওয়াপট্টিতে আছে ছোট-বড় প্রায় ৭০০ হালকা শিল্প কারখানা আর এখানে মূলত তৈরি হয় গ্রিল, তালা, ছাতার জালা, কব্জা, পাওয়ার প্রেস, কেলাম, শিট, প্লেনজার, কয়েল, ওয়াশার, নাট-বল্টু, স্ক্রু, তারকাঁটা, তোপকাঁটা, বালতি, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, কড়াই ইত্যাদি। টিনপট্টিতে তৈরি হয় টিন, শিট, কয়েল। এখানে ১৫-২০টি কারখানা আছে। তবে এর বাইরেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সেকেন্ডারি শিট মজুদ এবং গোপনে ঢেউটিন তৈরির কাজ করে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো করোগেশন মেশিনে দিন-রাত আমদানিকৃত জিপি শিট কেটে ঢেউটিন তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে।

‘তৈরি’ হচ্ছে অ্যান্ড্রয়েড ফোন : শুধু নিজের নাম লিখতে পারেন সুমন। কিন্তু কাজ তার ইঞ্জিনিয়ারের। হাতের নিমেষেই তৈরি করছে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন। রাজধানী লাগোয়া কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় সুমনরাই তৈরি করছেন চীনের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন সেট।

সীমাহীন অবজ্ঞায় আকাশছোঁয়া সম্ভাবনা : জিঞ্জিরা বিপ্লব বাংলাদেশকে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরিতে সক্ষমতা এনে দিয়েছে। এর নায়কদের পুঁথিগত জ্ঞানের অভাব থাকলেও কারিগরি জ্ঞানের অভাব নেই। কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে এসব কারিগরের কৃতিত্বে। তাদের সাফল্য এতটাই যে, এখন চীন, ভারতের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশি যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষা জিঞ্জিরা-শুভাড্যা থেকে শুরু করে কেরানীগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে হাজারো কারখানা।

তাদের জন্য কিছুই হয় না : শিল্প সেক্টরের অভিজ্ঞজনেরা জানিয়েছেন, জাপান, চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শিল্পোন্নত সব দেশই শুরুতে হালকা প্রকৌশল খাতে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। অথচ বাংলাদেশে সরকারিভাবে সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আর এতে জিঞ্জিরা শিল্পের আকাশছোঁয়া সম্ভাবনাও মাটিচাপা পড়েছে। হালকা ও ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালে জিঞ্জিরা প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার।

বাধা ডিঙিয়ে তবু এগিয়ে : এত অবজ্ঞা, এত অবহেলা— তার পরও জিঞ্জিরার বিপ্লব থেমে নেই। এই নীরব বিপ্লবের নায়কদের পুঁথিগত বিদ্যার অভাব থাকলেও কারিগরি জ্ঞানের অভাব নেই। তারা তাদের সে জ্ঞান দিয়ে উৎপাদন করছেন নানা ধরনের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ। কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে এসব কারিগরের কৃতিত্বে। তাদের সাফল্যে এখন চীন ও ভারতের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশি যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। জিঞ্জিরার সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা আর অবাক দক্ষতার দেশীয় কারিগরদের ভাগ্যে আজও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জোটেনি। তবু এগিয়ে চলছে জিঞ্জিরা।

 

 বেসরকারি পর্যায়েও ন্যূনতম সহায়তা করতে এগিয়ে যায়নি কেউ। বরং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিক অবহেলার শিকার ‘জিঞ্জিরা শিল্প’কে নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা চলছে নানাভাবে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের একচ্ছত্র বাজার নিশ্চিত করতে প্রথমেই আঘাত হানছেন জিঞ্জিরায়। তারা টাকা ছিটিয়ে প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসন দিয়ে জিঞ্জিরার ক্ষুদ্র কারখানাগুলোয় বার বার অভিযান চালাচ্ছেন। যখন-তখন নকলবাজির অভিযোগ তুলে এসব কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সীমাহীন বৈরী পরিবেশের মুখেও জিঞ্জিরার ক্ষুদ্র কারখানার কারিগররা হাত গুটিয়ে বসে থাকছেন না। চুপিসারে নিত্যনতুন জিনিসপত্র তৈরি করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন। সীমিত পুঁজির ক্ষুদ্র কারখানার মালিক আর অভাবনীয় মেধার দক্ষ কারিগররা জিঞ্জিরা শিল্পকে পরিণত করছেন দেশের সম্ভাবনাময় আলোকবর্তিকায়।

সর্বশেষ খবর