শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর বর্বরতার বর্ণনা

গুলশান হামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভয়ঙ্কর বর্বরতার বর্ণনা

গুলশানের হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ড চোখের সামনে দেখেছেন ভারতীয় চিকিৎসক সত্য প্রকাশ। গত ১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা হয়। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন।

চোখে দেখা ঘটনার বিবরণ দিয়ে ২৬ জুলাই আদালতে জবানবন্দি দেন সত্য প্রকাশ। ইংরেজিতে হাতে লেখা আট পাতার ওই জবানবন্দিতে ছিল হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, আতঙ্ক আর বাঁচার চেষ্টার বিবরণ। সত্য প্রকাশ বলেন, সাড়ে ৮টার দিকে রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। হঠাৎ দেখলাম দুই থেকে তিনজন লোক রেস্তোরাঁর মূল ফটকে ধাক্কা দিচ্ছে। এরপর শব্দ শুনতে পেলাম, যেটা পটকার আওয়াজের মতো। ছয় থেকে সাতজন লোক রেস্তোরাঁর দিকে ছুটে আসছিল। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। গুলির আওয়াজ শুনলাম এবং একজনকে পড়ে যেতে দেখলাম। এ সময় আমি ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান শুনলাম। একটি থামের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করছিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেখলাম একজন মুখে হাত চাপা দিয়ে ছুটছেন। তার মুখে রক্ত ছিল। জাপান, চীন ও কোরিয়ার মতো কোনো দেশের লোকের মতো চেহারা তার। এক শ্রীলঙ্কান দম্পতি যাদের আমি আগে থেকেই চিনতাম, তারাও লুকানোর জন্য থামের পেছনে এসেছেন। জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, একজন হামলাকারী মাটিতে পড়ে থাকা এক ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করছে। দম্পতি আসার পরপরই হামলাকারীদের একজন সেখানে এসে বলল, লুকিয়ে থাকবেন না। আপনাদের ক্ষতি করব না। আপনারা এখানে নিরাপদ নন। বেরিয়ে আসুন। আমরা তাদের কথামতো বেরিয়ে এলাম। ওই হামলাকারী আমাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে নিষেধ করল। আমি মুঠোফোন তাকে দিলাম। শ্রীলঙ্কার ওই দম্পতি তার ব্যাগ ছুড়ে দিল...।’

ওই হামলাকারী বললেন, আপনি বাঙালি? বললাম, হ্যাঁ, বাঙালি। হামলাকারী শুয়ে পড়তে বললেন। কথামতো শুয়ে পড়লাম। শ্রীলঙ্কান দম্পতি তখনো দাঁড়িয়ে। তারপর হামলাকারী আমাকে ভিতরে যেতে বলেন এবং অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে বসতে বলেন। আমাকে চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা নিচু করে রাখতে বলেন। টেবিলের নিচে দুই নারী লুকিয়ে ছিল। আক্রমণকারীরা তাদের বেরিয়ে আরেক পাশে বসতে বললেন। ওই মেয়েরা এবং তাদের সঙ্গে থাকা একজন তরুণ তাদের ছেড়ে দিতে কাকুতি-মিনতি করছিলেন। হামলাকারীরা বলেন, তোমরা কাফের বলে আমাদের কাছে গণ্য না হলে কোনো ক্ষতি করব না।

সত্য প্রকাশ বলেন, একজন হামলাকারী ইংরেজিতে বললেন, তোমরা কি জানো, কীভাবে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনেরা সিরিয়ায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, নিহত হচ্ছেন? আমি শুনতে পেলাম, হামলাকারীদের একজন এক তরুণের সঙ্গে ইসলাম নিয়ে কথা বলছেন (পরে জানতে পারি তার নাম তাহমিদ)। একজন হামলাকারী জানতে চাইলেন, সংবাদমাধ্যম বা পুলিশের কাউকে চিনি কিনা। আমি বললাম না। একটি মেয়ে হামলাকারীদের কথামতো তার মাকে ফোন করেন। মেয়েটি বললেন, আম্মা, তাড়াতাড়ি বেনজীর আঙ্কেলকে বলো, আমি এখানে (গুলশানে) আটকে আছি। এরপর আরেকটি ফোন বাজল। আমার উল্টো দিকে বসে থাকা এক ব্যক্তি ফোনের স্পিকার দিয়ে কথা বললেন। পরে জানতে পারি তার নাম হাসনাত। সত্য প্রকাশ বলেন, তারা আমাদের পানি ও কেক খেতে দেয়। তারা বাথরুমেও যেতে দেয়। বাথরুমে যাওয়ার সময় আমি দেখি, সিঁড়ির গোড়ায় এক নারী পড়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর আমি শুনতে পাই, রেস্তোরাঁর এক কর্মীকে হামলাকারীরা বলছে, রান্নাঘরে যারা আছে, তাদের যেন দরজা খুলে বের হয়ে আসতে বলা হয়। ওই কর্মী ভিতরে থাকা ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করে বললেন, হামলাকারীরা বাংলাদেশিদের হত্যা করবে না। এরপর হামলাকারীরা একবার ব্যর্থ চেষ্টার পর কোল্ড রুম (ভাণ্ডার) খুলতে সক্ষম হয়। এর ভিতরে দুজন ছিলেন। একজন রেস্তোরাঁর কর্মী এবং আরেকজন জাপানি। জঙ্গিদের হিংস তার বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দিতে বলা হয়, হামলাকারীরা বাঙালিকে অন্যদের সঙ্গে বসতে দেয় আর সেই জাপানি নাগরিককে গুলি করে। একপর্যায়ে শুনতে পাই এক নারী যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছেন। তাকে কোপাতে থাকা এক ব্যক্তি বলছিল, ‘মহিলা মরতেছে না।’

জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে সত্য প্রকাশ বলেন, তারা দুটি বড় গ্যাস সিলিন্ডার কাচের দরজার দুই পাশে রাখে। তারা মুঠোফোন, ট্যাবলেট ও ল্যাপটপ ব্যবহার করছিল। তারা হাসাহাসি করছিল আর উচ্চৈঃস্বরে বলছিল, তারা (সংবাদমাধ্যম) আগে আমাদের সন্ত্রাসবাদী বলত, এখন জঙ্গি বলছে। না জানি কাল কী বলবে। একপর্যায়ে তারা বাংলায় একটি বার্তা (মেসেজ) পড়ে শোনায়। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অভিনন্দন বার্তা। বার্তায় বলা হয়েছে, তারা খুব বড় কাজ করেছে, এ জন্য তাদের ভাইয়েরা তাদের নিয়ে গর্ববোধ করছে। এরপর তারা সেহে?রি খেতে দেয়। তাদের সন্দেহ এড়াতে আমিও কয়েক গ্রাস খাই। অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে, কেউ একজন নির্দেশ দিলেন, দুজন থাকবে ওপর তলায়, দুজন নিচে। একজনকে কিছু একটা করতে বলা হয়, যা আমার মনে পড়ছে না। এ সময় দেখি, একজন হামলাকারী হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি দেখলাম, টাক মাথার লোকটি (হাসনাত) সামনের দরজা খুলছেন। সত্য প্রকাশ বলেন, এক হামলাকারী তাহমিদকে কোরআন শরিফ দিচ্ছিল। কিন্তু তাহমিদ নিতে অস্বীকৃতি জানান। আমি তা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তারা আমাদের ফোন ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়। আমরা রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করি।

সর্বশেষ খবর