বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঋণের পাহাড়ে ঠিকানাহীন কোম্পানি

নজরদারিবিহীন ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, পরিদর্শন ছাড়াই পাস হচ্ছে ঋণ

আলী রিয়াজ

জাল দলিল ব্যবহার করে লুটপাট চলছে ব্যাংকিং খাতে। ঠিকানাহীন কোম্পানির নামে ব্যাংক ঋণ নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান এর মালিকরা। ভুয়া কোম্পানির কাগজপত্র তৈরি করে ঋণ নিচ্ছেন একশ্রেণির নামসর্বস্ব শিল্পপতি। ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য, কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব কোম্পানির কোনো সরেজমিন পরিদর্শন ছাড়াই ঋণ পাস হয়ে যাচ্ছে। ঋণ দেওয়ার পর দেখা যায়, ঠিকানা ব্যবহার করা হয় সেখানে কিছুই নেই। এমনকি যার নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে ওই নামেই কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের অভাবে ব্যাংকিং খাতে এমন ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে এমন কোম্পানির বিরুদ্ধে কয়েকশ’ অভিযোগ এসেছে। এই সময় ভুয়া ঠিকানা, জাল দলিল, মর্টগেজ ব্যবহার করে নেওয়া ঋণের মধ্যে ২২ হাজার কোটি টাকা রাইট অফ (অবলোপন) করেছে। গত ডিসেম্বরে যেখানে মোট খেলাপির পরিমাণ ছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ তা এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকেরই সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১০ সালে ব্যাংক খাতে ঋণ অবলোপনের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ সালে অবলোপন করা ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত তা ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অবলোপন করা ঋণের মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকেই ১৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকা, আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ১৩ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। এই অবলোপনের একটি বড় অংশ ঠিকানাবিহীন ভুয়া কোম্পানির বিপরীতে ঋণ। ঠিকানাবিহীন এমন কোম্পানির বিপরীতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে যা ব্যাংকগুলো আর ফেরত আনতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক অভিযোগের তদন্ত করে বের করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। বৃহৎ অঙ্কের ঋণ পাস হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন করার কথা থাকলেও তারা তা করছে না। ফলে প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক ব্যবস্থা এখনো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি ভয়াবহ। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে লুটপাট করছে দুর্নীতিবাজরা। তাদের দুর্নীতির কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে আজ মূলধন নেই। সবগুলো ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতি পোষাতে জনগণের করের টাকায় বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঘাটতি পূরণে অর্থমন্ত্রী নিজের পকেট থেকে টাকা দিচ্ছেন না। জনগণের করের টাকা এসব ব্যাংকে মূলধন হিসেবে জোগান দেওয়া হচ্ছে। এভাবে টাকা লুটপাট হচ্ছে, এসব বন্ধ করতে হবে। সরকারি ব্যাংগুলোতে ২০ শতাংশের বেশি মূলধন ঘাটতি হলে তাদের পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ ক্ষমতা দিতে হবে। তার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন প্রয়োজন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিংও খুব দুর্বল। যে কোম্পানির কোনো ঠিকানাই নেই তার জন্য কীভাবে ঋণ পাস হয়। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের খুঁজে বের করতে হবে। লুটপাট, দুর্নীতি শুধু ব্যাংক কর্মকর্তারা নয়, রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়োগ করা পর্ষদ সদস্যরাও দায়ী। খেলাপি ঋণ আদায় করে ব্যাংকের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।

জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। ব্যাংকগুলোতে বারবার একই ধরনের অনিয়ম জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যেরকম জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তেমনি আদায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাংকগুলো নানা অনিয়ম করছে। ভুয়া কাগজ দিয়ে ঋণ নেওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে ২০১৬ সালেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বসানোর পরেও ঋণ জালিয়াতি কমেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগে একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ঋণ নেওয়ার আগে আমাদের কোনো পরিদর্শনের ব্যবস্থা নেই। কোনো পরিদর্শন আমরা করি না। ঋণ নেওয়ার পর আমাদের কাছে আসে। এরপরে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্রই ভুয়া দেখা যায়। পরিদর্শনে জালিয়াতি অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পরেও আমাদের শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমরা শুধু তদন্ত করে চিহ্নিত করে দিতে পারি। সিন্ডিকেট : পুরো ব্যাংকিং সিস্টেমে একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে যাদের কাজ হচ্ছে কোম্পানির প্রোফাইল তৈরি করে আরজেএসসি থেকে পাস করানো। আরজেএসসি থেকে কোম্পানির প্রোফাইল পাস করার পর ঋণের জন্য জমা দেওয়া হয় ব্যাংককে। দেশের বিভিন্ন শিল্প সমৃদ্ধ এলাকায় জমির ওপর দলিল তৈরি করা হয়। কোম্পানির প্রোফাইলের সঙ্গে ওই জাল দলিলও বন্ধক হিসেবে দেখানো হয়। বাস্তবে কিছু না থাকলেও কাগজপত্র দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলো পুরোপুরি ভুয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে কোনো সরেজমিন পরিদর্শন ছাড়াই এসব কোম্পানির বিপরীতে শত শত কোটি টাকা অনুমোদন হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুরো কার্যক্রমে জড়িত থাকেন ব্যাংকেরই কর্মকর্তারা। অনেক সময় আলাদা কোনো প্রকল্পের জন্য আনা মেশিনারিজ ভুয়া প্রোফাইল জমা দেওয়া কোম্পানির হিসেবেও দেখানো হয়। ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য, শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণও প্রদান করা হয়। ছয় মাস থেকে এক বছর পরই বিষয়টি সামনে আসে যখন ঋণের কিস্তির সময় হয়। তখন ব্যাংক থেকে লোক গিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় কাউকে পায় না। ব্যাংক ছাড়া একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকও চরম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। গত নভেম্বর মাসে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা নিজেরাই ঋণ নিয়েছেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে বিষয়টি ধরা পড়ে। ওই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রমাণ পায় বিআইএফসিএল ও পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকরা যোগসাজশ করে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা একে অপরের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়। যেসব ঋণের কাগজপত্রও ছিল ভুয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সবার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

সর্বশেষ খবর