বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

অপরাধের নিত্যনতুন কৌশলে বিদেশিরা

মাহবুব মমতাজী

দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে অবৈধভাবে থাকা বিদেশি নাগরিকরা। বিশেষ করে তারা জাল ডলার, জাল টাকা, অপহরণ ও মাদক চোরাচালানের মতো কারবারে লিপ্ত হয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, এসব বিদেশির মধ্যে বেশির ভাগই সীমান্ত পাড়ি দেওয়া অনুপ্রবেশকারী। এরা অপরাধ কর্মকাণ্ডে নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করছে। যেমন— এদের অনেকে বিভিন্ন অঞ্চলে এদেশের নাগরিকদের বিবাহ করছে। তারপর সেখানে সামাজিক অবস্থান তৈরি করে অপরাধ কর্মে লিপ্ত হচ্ছে। এ ছাড়া ভিসা নিয়ে আসাদের ভিতরেও অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ফিরে যাচ্ছে না। তারাও নানা কৌশলে এদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকছে। রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বসবাস করে তারা চালিয়ে যাচ্ছে অপরাধ কর্ম। ওয়াকেবহালদের মতে, অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য ধরা পড়ে এদের অনেককে কারাগারেও যেতে হয়েছে। কিন্তু কারাভোগের পর ছাড়া পেয়ে এরা নিজ দেশে ফিরে যায়নি বা যেতে পারছে না। এ অবস্থায় তারা লিপ্ত হচ্ছে জাল ডলার, জাল টাকা, অপহরণ ও মাদক চোরাচালানের মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই বছরে ভয়ঙ্কর অপরাধ কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্তত ৪৪ জন বিদেশিকে আটক করা হয়। কিন্তু কারাভোগ শেষে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে পারছে না সরকার। কারণ এসব দেশের বেশির ভাগেরই বাংলাদেশে দূতাবাস নেই। পুলিশ জানায়, ১৩ আগস্ট ফেনীর পরশুরামের কাউতলী সীমান্ত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় তিনজন নাইজেরিয়ান নাগরিককে আটক করা হয়। তারা হলেন ডামিয়ান নাওয়াডুজে, ভিক্টর ও আসটেনটাইন ইকতেপাকু। তাদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালের ৫ জুলাই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মদ-গাঁজা-ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ এক বিদেশি নাগরিককে আটক করে র‌্যাব-২। তিনি কোরিয়ান নাগরিক জি এন পার্ক। ২০১৪ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানের অভিযোগে ৩১ জন বিদেশি নাগরিককে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের উত্তরা ও বনশ্রী এলাকা থেকে আটক করা হয়। প্রতারণা ও জাল ডলার বিক্রির অপরাধে ৭ আগস্ট ৯ অবৈধ বিদেশিকে আটক করে র‌্যাব। তাদের মধ্যে ছয়জন ছিলেন ক্যামেরুন, দুজন কঙ্গো এবং একজন লেসেথোর নাগরিক। তাদের চারজনের কাছেই পাসপোর্ট পাওয়া যায়। বাকি পাঁচজনের পাসপোর্ট উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র‌্যাব সূত্র জানায়, দেশে যেসব অবৈধ বিদেশি আস্তানা গেড়েছে, তাদের বেশির ভাগই অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে অনুপ্রবেশ করা। তারা গ্রাম-গঞ্জে নিম্নবিত্ত সহজ-সরল পরিবারের মেয়ে বিয়ে করে সেখানকার সমাজের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নেন। এসব বিয়েতে মানা হয় না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশনা। সূত্র মতে, শতাধিক দেশের দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। এসব দেশের নাগরিকরা অন অ্যারাইভাল ভিসা, তিন মাসের ভিসা, কিংবা ছয় মাসের ভিসা নিয়ে এদেশে প্রবেশ করেন। আবার অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশে এসে সেখান থেকে অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করে বসবাস শুরু করে দেন। এরপর তারা সংঘবদ্ধ চক্র হয়ে চালিয়ে যান অপরাধ জগতের নিয়মিত কার্যক্রম। দেখা গেছে, চক্রগুলো প্রথমে রাজধানীর ধানমন্ডি, উত্তরা, বনানী, গুলশান ও বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বাস করতে থাকেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় দেশীয় অসাধু কিছু চক্র। যারা অবস্থা বুঝে নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তিকে টার্গেট করে তার ই-মেইল, মোবাইল নম্বর এবং পেশা সম্পর্কে জেনে নেয়। প্রথমে স্বল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফার একটি ব্যবসার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে তারা ই-মেইল পাঠায়। কিছু দিন ই-মেইল চালাচালির পর যোগাযোগ শুরু হয় মুঠোফোনে। এরপর তাদেরকে আসল ডলারের কথা বলে দেওয়া হয় জাল ডলার। সেসব ডলারে এমন কিছু কেমিক্যাল পদার্থ ব্যবহার করা হয় যেগুলো যে কোনো সাধারণ নাগরিকের পক্ষে চেনা সম্ভব নয়। এভাবে অবৈধ বিদেশি চক্রগুলো বিপুল পরিমাণ টাকা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়ে নিজ দেশে পাচার করছে। এরা জাল ডলার বিক্রির পাশাপাশি জাল টাকা তৈরি এবং তা বিক্রির নেটওয়ার্কও স্থাপন করে। এদের কেউ আবার একই কৌশলে ধনী কোনো ব্যক্তিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। এসব কাজে বিদেশি অপরাধীরা ব্যবহার করছে শতাধিক নিবন্ধিত দেশীয় সিম। এ ছাড়া বিদেশি সিমের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন সরঞ্জামও ব্যবহার করছে তারা।  সূত্র আরও জানায়, বিদেশিদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের কারণেই অবৈধ চোরাচালানে দেশের মধ্যে বিস্তার লাভ করছে মাদকের সাম্রাজ্য। তারা সুকৌশলে বিভিন্ন দেশ থেকে কোকেন, ইয়াবা, মদ, হেরোইন, আফিম, অ্যামফিটামাইন, বারবিচুরেটস,  বেনজোডায়াজিপাইনস, ওপিয়াম, ক্যানাবিস ও পেথিড্রিনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য এনে এখানকার যুবকদের মধ্যে সরবরাহ করছে। যদিও এসব ঘটনায় অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় কারাভোগও করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু কারাভোগের মেয়াদ শেষে অনেকে যাওয়ার কোনো জায়গা না পেয়ে কারাগারের মধ্যেই থেকে যায়। আবার কেউ কেউ ছাড়া পেয়ে নতুন করে জড়িয়ে পড়ে একই অপরাধে। তবে কারাভোগ শেষে অধিকাংশের দূতাবাস এদেশে না থাকায় তাদেরকে নিজ দেশে পাঠাতে জটিলতা দেখা দেয়। যে কারণে তাদেরকে ফেরত পাঠানো যায় না। এমনকি তারা যখন অপরাধ কাজে যুক্ত থাকে তখন তাদের ভাষাগত কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্তু র‌্যাব বা পুলিশের কাছে ধরা পড়লে তাদের মধ্যে দেখা যায় এক ধরনের ভাষাগত সমস্যা। ভাষা বুঝতে না পেরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও মূল হোতাদের তথ্য বের করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সূত্র জানায়, কঙ্গো, ক্যামেরুন, লেসেথো, সেনেগাল, উগান্ডা ও মালিসহ বেশ কিছু দেশের নাগরিকরা এসব কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে হরহামেশা। তাদের কোনো দূতাবাস বাংলাদেশে নেই। অপরাধীদের অনেকে পাসপোর্ট ছাড়াই অবস্থান করছে এদেশে। পাসপোর্ট না থাকায় কোনো কোনো অপরাধীর দেশও শনাক্ত করা যায় না।  এ বিষয়ে র‌্যাব-৩ এর অপারেশন অফিসার মো. আবদুল করিম জানান, যেসব অবৈধ বিদেশি এদেশে অনুপ্রবেশের দায়ে ধরা পড়ে তাদের বিচার হয় এবং বিচারে সাজাও হয়। সাজা শেষে তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি দেখার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। র‌্যাব-২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, যেসব বিদেশি অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছে, তারা অন অ্যারাইভাল, তিন অথবা ছয় মাসের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কেউ কেউ বৈধ পথে প্রবেশ করে অবৈধ হয়ে যায়। আবার অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশ হয়ে সীমান্ত পার হয়ে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে অপরাধ করে। এসব ঘটনায় বিচারে সাজা হওয়ার পর তাদেরকে ফেরত পাঠাতে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। বিশেষ করে সেসব দেশের দূতাবাস না থাকায় এবং বিভিন্ন জটিলতায় সরকার তাদের ফেরত পাঠাতে পারে না। অবৈধ বিদেশিদের বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, অবৈধভাবে যারা এদেশে আছে, তারা যে পথে এসেছেন সে পথেই ফেরত পাঠানো যেতে পারে। এ ছাড়াও যেসব বিদেশির দূতাবাস আমাদের দেশে নেই তাদের বিষয়ে সরকার আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভিসা নিয়েই এরা দেশে আসে। এখানে এসেই জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দুষ্কর্মে। ভিসা শেষ হওয়ার পর তারা আত্মগোপনে চলে যায়। আত্মগোপনে থেকেই জালিয়াতি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। অবৈধভাবে অবস্থান করা এমন বিদেশিদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময় কাজ করছে। এদের সংখ্যা হালনাগাদ করতে এরই মধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর