শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফের পুঁজিবাজারে লুটপাট মনোপলির আশঙ্কা

শিথিল হচ্ছে পরিচালকদের শেয়ার

রুহুল আমিন রাসেল

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহের পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ২ শতাংশ রাখার শর্ত শিথিল করার উদ্যোগে আর্থিক খাতে আবারও লুটপাটের ষড়যন্ত্র দেখছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। তাদের আশঙ্কা, উত্থান-পতনের এ শেয়ারবাজার মনোপলি করে কিছু সুযোগ-সন্ধানীকে ফের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক করা হচ্ছে। এরপর আবার শেয়ারবাজার চাঙ্গা হলে ২০১০ সালের মতো ওই স্বার্থান্বেষী মহল সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুট করে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাবেন।

তথ্যমতে, ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসে ৩৩ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকে শেষ সম্বল হারিয়ে পথে বসে যান। কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছিলেন। এরপর পাঁচ বছরে পুঁজিবাজারে সংস্কারের কারণে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। ফলে এখন পুঁজিবাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতার ভাব দেখা গেলেও, আগের মতো চাঙ্গা হয়নি। এমন সংকটের মধ্যেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন—বিএসইসি সম্প্রতি  অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়ে বলেছে, পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ২ শতাংশ ধারণের শর্ত শিথিল করা হোক। পরিশোধিত মূলধনের ওপর ভিত্তি করে পরিচালকদের এককভাবে ন্যূনতম শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ এবং সম্মিলিত শেয়ার ধারণের শর্ত ন্যূনতম ১০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নির্ধারণ করা হোক। এ প্রস্তাব পাওয়ার বিষয় স্বীকার করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক-প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। জানা গেছে, বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন যাই হোক না কেন, সব পরিচালককে (স্বতন্ত্র ব্যতীত) ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ছাড়া উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের শর্ত রয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে শেয়ারবাজারে ধস নামার পর তা ঠেকাতে ২০১১ সালের নভেম্বরে পুনর্গঠিত কমিশন এ শর্ত আরোপ করে। এ শর্ত পরিপালন করতে না পারায় অনেকে কোম্পানির পরিচালক পদ ছাড়তে বাধ্য হন। কয়েকটি ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির পরিচালকরা বিএসইসির এমন নির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান। তবে আইনি লড়াইয়ে তারা হেরে যান। কয়েকটি মামলা এখনো বিচারাধীন। গত ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ২ শতাংশ রাখার শর্ত যখন আরোপ করা হয়েছিল, তখনই আপত্তি করেছিলাম। এমনই ধনীবাদী দেশ, এখন আরও অর্থ ধনীদের হাতে চলে যাবে। সাধারণ শেয়ার হোল্ডারদের হাতে কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনাও ঠিক নয়। এখানে সব শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে আস্থাটাই বড়। ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস—বিএবি’র সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংক-কোম্পানি পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ২ শতাংশ রাখার শর্ত শিথিল হলে ব্যক্তি-বিশেষ লাভবান হবেন। শেয়ারবাজারের কোনো উন্নতি হবে না। কিন্তু ২০ থেকে ৩০ জন নতুন করে ব্যাংকের পরিচালক হবেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের একাধিক পরিচালক বলেন, পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার মধ্যে শেয়ারবাজারের জন্য কোনো ইতিবাচক দিক নেই। বরং শেয়ারবাজার ও ব্যাংকিং খাতে মনোপলি বা একচেটিয়াত্ব তৈরি হতে পারে। ফলে যারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একজন ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেবেন, তার ২ শতাংশ শেয়ার থাকবে না, তা মেনে নেওয়া যায় না। কারণ ব্যাংক চালাতে গিয়ে একজন পরিচালককে বোর্ডে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু পরিচালক যদি যোগ্য না হন, তাহলে ঋণ বিতরণে অনিয়ম হতে পারে। ফলে যে সব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদান করা হয়, সেখানে যোগ্যতা ও সক্ষমতা বিবেচিত না হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে লুটপাট বাড়ছে। জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন থাকা বিএসইসি’র ওই নতুন প্রস্তাবে আরও বলা হয়— তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ভিত্তিতে চারটি ধাপ থাকবে। প্রথম ধাপে পরিশোধিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা হলে পরিচালকদের এককভাবে পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। তবে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে বর্তমানে পরিশোধিত মূলধন ২০০ কোটি বা তার কম এমন কোম্পানি সংখ্যা ২৩১টি। ২০০ কোটি টাকার বেশি, কিন্তু ৫০০ কোটি টাকার কম এমন কোম্পানির সংখ্যা ২৭টি। ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি, কিন্তু ১ হাজার কোটি টাকার কম কোম্পানির সংখ্যা ২৮টি এবং ১ হাজার কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধনবিশিষ্ট কোম্পানির সংখ্যা ৭টি। উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা, পরিচালকদের ন্যূনতম শেয়ার ধারণের বিষয়ে ২০১১ সালের ২২ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তৎকালীন এসইসি বা বর্তমানের বিএসইসি। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ওই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ এবং প্রত্যেক পরিচালকের ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। ন্যূনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ পরিচালকরা পদ হারাবেন এবং ৫ শতাংশ বা তার বেশি শেয়ার ধারণকারী কোম্পানির পরবর্তী বার্ষিক সাধারণ সভায় পরিচালক নির্বাচিত হবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। এসইসির আদেশ পালনের মেয়াদ ২০১২ সালের ২১ মে শেষ হয়েছে। এ আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে করা তিনটি রিট আবেদনও খারিজ হয়ে গেছে। এর ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অসংখ্য পরিচালক তখন ন্যূনতম শেয়ার ধারণে ব্যর্থ হয়ে পদ হারিয়েছিলেন। তখন বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ ছিল— পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ কোম্পানির পরিচালকদের কম দামে শেয়ার ক্রয়ের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে। এ সুযোগে শেয়ারবাজারে পতন ঘটিয়ে পরিচালকরা তাদের ন্যূনতম শেয়ার কেনার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। ২০১১ সালের শেষ দিকে কোনো শেয়ার না থাকার পরও সুযোগ-সন্ধানীরা কোম্পানির পরিচালক সেজে মালিকানার দখল নিয়েছেন। পুরো কোম্পানি নিয়ন্ত্রণও করেছেন।

শেয়ারবাজার কারসাজির সিন্ডিকেটগুলো তখন সরব হয় এবং কোম্পানি পরিচালকদের ৩০ শতাংশ শেয়ার সংরক্ষণের সরকারি বাধ্যবাধকতা তোয়াক্কা করেনি। ফলে তখন ২ শতাংশের নিচে শেয়ার সংখ্যা সংরক্ষণকারী পরিচালকের সংখ্যা হয় ৩২০ জন। তাদের মধ্যে অনেকের শূন্য শতাংশ শেয়ারও নেই। এমনকি ২০১১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেয়ার ক্রয় করে নির্ধারিত সীমা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে তাদের অনেকেই পরিচালক পদই হারান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ তখন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালকরা সবার চোখের সামনেই শেয়ার বিক্রি করেছে। এসইসির নীরবতার কারণেই কোম্পানির পরিচালকরা এই ধরনের অসাধুপায় গ্রহণ করেছে। প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রি নিষিদ্ধ করে নির্দেশনা জারি করে তৎকালীন এসইসি। এরপর একই বছর ২২ নভেম্বর এসইসির পক্ষ থেকে আরেকটি নির্দেশনা জারি করে বলা হয়, যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশের কম শেয়ার রয়েছে, তাদের আগামী ছয় মাসের মধ্যে শেয়ার কিনে পূরণ করতে হবে।

সর্বশেষ খবর